আত্মীয়সমাজ কবে নাগরিক সমাজ হবে?

পশ্চিমের উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে আত্মীয়তার বন্ধন ও সামাজিক সম্পর্কগুলো অনেক দৃঢ়, খাঁটি এবং এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। শুধু 

তাই নয়, যেকোনো সম্পর্ককেই—সেটা রাজনৈতিক থেকে দাপ্তরিক যা-ই হোক না কেন, আত্মীয়তার পরিচয়ে বাঁধতে আমরা ভালোবাসি। আমরা নিস্পৃহ (এবং নিরপেক্ষ) মানুষকে সাধারণত ভালোবাসি না, মনে করি সেই ব্যক্তি হৃদয়বান নন, যান্ত্রিক ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাঁকে এড়িয়ে চলাই আমাদের স্বভাব। আইন বা নিয়মের দোহাই মানতে চায় না স্নেহ-ভক্তির দাবি।

এই ইনফর্মাল স্বভাব ও অভ্যাস নিয়ে আমরা গর্বিত। সত্যিই এর যেমন মানবিক দিক আছে, তেমনি আছে কার্যকারিতা। এমনকি কখন কাকে কাজে লাগবে সেই বিবেচনায় সম্পর্ক পাতানোও হয়। বলা বাহুল্য ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরি করায় সবার মধ্যে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা দেখা যায়। সম্পর্কে সব সময় স্বার্থচিন্তাই মুখ্য হয় না, অনেক ক্ষেত্রে একেবারে অনাত্মীয় ব্যক্তি বা পরিবারে নিঃস্বার্থ মানবিক সম্পর্ক আত্মীয়তার মর্যাদা পেয়ে যায়। পরিচয়ের সূত্র ধরে বাড়তি খাতির করা বা দেওয়া এ সমাজের বৈশিষ্ট্য। আর পরিবারে কেউ বিখ্যাত বা সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি থাকলে তাঁর নাম ভাঙিয়েও অনেক সুবিধা আদায় করা যায়। তেমন ব্যক্তি অনেক সময় নিজের এই প্রতিপত্তি উপভোগও করেন। আর উপকৃত ব্যক্তি সচরাচর সপরিবারে তাঁর প্রতি অনুগত থাকেন। সমাজে এই ইনফর্মাল সংযোগ ও তার কার্যকারিতা এখনো ব্যাপক।

সাধারণত প্রথম প্রজন্মের যাঁরা চাকরি-ব্যবসা সূত্রে শহরে বসতি করেছেন, তাঁদের ওপর অলিখিত দায় ন্যস্ত করেন পেছনে গ্রামে রেখে আসা আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, মায় গ্রামবাসী; এমনকি উপজেলা, জেলা পর্যায় পর্যন্ত এ রকম দাবি প্রসারিত হতে পারে।

ঘনিষ্ঠদের প্রতিপাল্যকে বাসায় রেখে পড়াশোনার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সাধারণ লোকাচার। অনেকের বেড়ানোর শখ মেটানো, বিয়ের বাজার, নিছক শহর ঘুরে দেখার বা অন্যত্র যাওয়ার পথে ট্রানজিট হিসেবে আস্তানা দেওয়ার দাবিও পূরণ করতে হয়। সত্যি বলতে কী এসব এতই স্বাভাবিক যে এ নিয়ে টানাপোড়েন কমই হয়। এর আরও মহৎ মানবিক দিকও দেখেছি।

বিপদেই বন্ধুর পরিচয়, সত্যিই বিপদে-আপদে জান দিয়ে পাশে দাঁড়াতে, বুক দিয়ে আগলাতেও দেখা যায়। হিন্দু-মুসলমান পরিবারে বড়দের নিজেদের মধ্যে ও সন্তানদের নিয়ে আপন-পর ভেদাভেদ বলে কিছু নেই, এই সাম্প্রদায়িকতার দেশে এমন সখ্যও দেখেছি। এই সম্পর্কগুলো মানবিক এবং চমৎকারভাবে কার্যকর, কারণ এগুলো মানুষের আন্তরিক, হার্দিক সম্পর্ক—অযাচিত, প্রবল এবং বেহিসাবি।

এভাবে চলার অভ্যাসকে আমরা গ্রাম থেকে নগরেও টেনে এনেছি। কারণ, এতে কাজ পাওয়া বা হওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। তদুপরি ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমাদের অফিস-আদালত-হাসপাতাল কোথাও সাধারণ মানুষ তার নাগরিক মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে ন্যায্য প্রতিকার ও সেবা পায় না। ফলে কোথাও কারও কাজ থাকলে প্রথমেই তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসে পরিচিতজনের খোঁজ করেন। নিজের পরিচিত না থাকলে, পরিচিতজনের মাধ্যমে সেই দপ্তরের আরাধ্য পরিচিতজনের কাছে পৌঁছে যাই আমরা।

কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হলে প্রথমেই খোঁজ পড়ে সেখানকার পরিচিত ডাক্তারের। তাঁকে ধরে তাঁর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তবে হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করাতে সাহস পাই আমরা। নয়তো নয়। এভাবে পরিচিতের পরিচিতজনের সূত্র খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় একাধিক ব্যক্তি মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ আপনার মামার পরিচিত ডাক্তার এমন এক ডাক্তারকে বলে দেবেন, যিনি আদতে তাঁর শালার বন্ধুর ভগ্নিপতি। আপনি ভরসা রাখতে পারবেন, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ হওয়ার হলে এতেই হবে।

আবারও বলি এই ধারাটা মানবিক, কিন্তু এভাবে একটি নাগরিক সমাজ কি সত্যিই গড়ে উঠতে পারে? আমার বিবেচনায় আমাদের এটি এখনো আত্মীয়সমাজ হিসেবেই চলছে, নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। নাগরিক সমাজের বৈশিষ্ট্য, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য, আইনের শাসন, দাপ্তরিক বিধান ও পদ্ধতি ইত্যাদি যে আমরা জানি না তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এমনকি আত্মীয় খুঁজে নেওয়ার সময়-সুযোগ না থাকলে সেখানে অল্প পয়সার বিনিময়ে এই আত্মীয়তুল্য সেবা দেওয়ার জন্যও মানুষ তৈরি থাকেন। গ্রাম থেকে বা দূরাঞ্চল থেকে আসা মানুষ বিফল হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেন না। তাতে তাঁর ব্যয় আরও বেড়ে যাবে বলে তাঁরাই এই দালালশ্রেণিকে পোষেন।

এই অভ্যাস মজ্জাগত হয়ে যাওয়ার ফলে পরিচিতদের খাতির করা অনেকেই স্বাভাবিক দায় হিসেবে নেন, কেউ এতে কিছুটা আত্মপ্রসাদ পান, আবার অনেকে এটুকু দিতে না পারলে অপরাধবোধে ভোগেন। স্বতঃপ্রণোদিত উপকারের দৃষ্টান্ত আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে। একবার প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি, সেন্টারের এক পরিচালক-ডাক্তার দেখতে পেয়ে প্রায় ধমক-অনুযোগের মিশ্রণে বললেন, আরে আপনি কেন লাইনে দাঁড়িয়ে! এবং জোর করে তাঁর চেম্বারে নিয়ে বিলে অনেকটা রেয়াত দিয়ে সহকারীকে ডেকে রক্ত ইত্যাদি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সঙ্গে কফি-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করতেও ভোলেননি। তাঁকে ঠাট্টা করে বলি, এভাবে অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছেন, কেবল ষাটোর্ধ্ব বা পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্বদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা, কিছু রেয়াত নির্ধারণ করে দিলেই হতো। ভাবি, চক-মিলানো প্রতিষ্ঠানে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ ও প্রদর্শনে তাঁরও তো সন্তুষ্টির ব্যাপার আছে!

শেষ করি এই বলে যে আত্মীয়সমাজের আকাঙ্ক্ষা-আবদার সীমা মানতে চায় না। রাষ্ট্রের কিছু পদ প্রতিষ্ঠানতুল্য, তাকে সেই মর্যাদা দিতে হবে, রাষ্ট্রের কিছু সার্ভিস আছে যেগুলো জনসমাজ বা আত্মীয় থেকে আলাদা থাকবে। কিন্তু আত্মীয়সমাজ কাউকে দূরে থাকতে বা রাখতে চায় না। একজন রাজনীতিবিদের পক্ষে তাঁর সরকারি দায়িত্ব (ধরা যাক মন্ত্রী), এবং রাজনৈতিক পদাধিকারের গণ্ডি মেনে আত্মীয়, এলাকাবাসী, শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের বন্ধুত্বের দাবি সংশ্লিষ্টদের মনে আঘাত-দুঃখ না দিয়ে সুষ্ঠুভাবে হ্যান্ডেল করা সত্যিই কঠিন। বাঙালির অভিমান বড্ড সুলভ এবং প্রবল।

এটা ঠিক এ দেশে অফিস–আদালত যেভাবে চলে তাতে বাড়তি সম্পর্কের বরকত তো আছেই, এতে সময় বাঁচে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত হয়। আর ঔপনিবেশিক ধারার অফিস যেহেতু চলে নাগরিকজনদের প্রতি অবিশ্বাসের ভিত্তিতে, সেখানে অচেনা আগন্তুকের ন্যায্য কাজও অফিসের নিয়মে যথাসময়ে হতে চায় না। সবাই এর ভুক্তভোগী বলে পরিচিতজন খুঁজে নিতে এত ব্যস্ত আমরা।

কিন্তু মুশকিল হলো আত্মীয়সমাজ তো নাগরিক সমাজ নয়। এখানে আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র ঠিকঠাকভাবে বিকশিত হবে না। নিস্পৃহ নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা তো কোনো পক্ষেরই পছন্দ হবে না, হচ্ছে না। তাই সব আইন, বিধান, ব্যবস্থার মধ্যে আত্মীয়তার দাবি তুলে সহজেই ফাঁকফোকর তৈরি করা হয়, যাতে আবার কোনো পদ্ধতি নিজস্ব নিয়মে চলতে পারে না। আর খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে আত্মীয়সমাজের ভিত্তি স্বজনতোষণ, এর সহজাত অনুষঙ্গ দুর্নীতি এবং এর পরিণতি বৈষম্য ও অন্যায়। এসব কারণেই নাগরিক সমাজে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি এক প্রকার অসম্ভব।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক