সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনে সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই

কিছুদিন পরপর নিয়ম অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার পান, আমাদের সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীরা তার চেয়ে বিশেষ কম প্রচার পান—তা বলা যাবে না। মাসখানেক পত্রপত্রিকাগুলোর প্রথম পাতার প্রধান প্রতিবেদন হয় তাঁদের ছবিসহ। টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ।

যেকোনো কারণেই হোক দেশের মানুষের জীবন থেকে নির্মল আনন্দের খোরাক হারিয়ে গেছে। উপভোগ্য নাটকের অভাব। মনকে সতেজ করে এমন সংগীত নেই। উচ্চাঙ্গসংগীত ও যন্ত্রসংগীত দীর্ঘ সময় ধরে উপভোগ করতে হবে বলে তা প্রায় উঠেই গেছে। জীবন ও জগৎ নিয়ে চিন্তাশীল ও দার্শনিক আলোচনার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এখনো দেশের প্রত্যন্ত এলাকার অনেক মানুষ গঠনমূলক কাজ করছেন। তাঁদের সম্পর্কে নেই কোনো প্রতিবেদন। প্রাণহীন কর্তাভজা টক শো দিয়ে দর্শকদের টিভি সেটের সামনে বসিয়ে রাখা যায় না। সে অবস্থায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বৈচিত্র্যময় প্রচার মানুষ উপভোগ না করে যাবে কোথায়?

আগে বলা হতো পৌরসভা বা করপোরেশনের চেয়ারম্যান। ওই পদবি খুব সাদামাটা ও সেকেলে হয়ে পড়ায় করা হয়েছে মেয়র। মেয়র পদবিতে রয়েছে গাম্ভীর্য। কিন্তু মিডিয়া পদবিটিকে আরও সম্মানসূচক করতে নিজের থেকেই বলছে সিটি ফাদার বা নগরপিতা। তার অর্থ দাঁড়ায় সমগ্র নগরীর তিনি পিতৃতুল্য এবং নগরবাসী তাঁর সন্তান। নাগরিকদের প্রত্যেকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবেন। তা যে করবেন তা তাঁদের নির্বাচনী প্রচারের সময় তাঁরা উদাত্ত কণ্ঠে প্রচার করেন। প্রচারের সময় দেখা যায়, নগরপিতা পদপ্রার্থী বস্তির যে বৃদ্ধ বাতের ব্যথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে অক্ষম, তাঁকে গিয়ে টান মেরে খাড়া করে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। কোনো বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁর দোয়া চাইছেন। বৃদ্ধার ঘরের সামনে এক যুগ ধরে যে খানাখন্দে পানি জমে আছে, তা ভরাট করে পাকা রাস্তা বানিয়ে দেওয়ার ওয়াদা করেন অবলীলায়। এসব কারণে সাংবাদিকেরাও দেখছেন এমন বিনম্র মানুষটি নির্বাচিত হলে তিনি নগরীর পিতা না হয়েই পারেন না।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এলাকাবিশেষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, এলাকার উন্নয়নের জন্য গঠিত হয়। এটা অতি প্রাচীন প্রথা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার ছিল। সেই মহেঞ্জোদারোতে ছিল। হরপ্পায় ছিল। তক্ষশীলায় ছিল। মহাস্থানগড়ে ছিল। কোনো না-কোনো প্রক্রিয়ায় নগরীর প্রশাসক নির্বাচিত বা জনগণের দ্বারা মনোনীত হতেন।

এই ভূখণ্ডের মানুষ এখনকার মতো পরিপূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগের এক শতাব্দী আগে থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেখে অভ্যস্ত। লোকাল বোর্ড, জেলা বোর্ড ও পৌরসভায় দেখেছে। ঢাকাসহ বড় বড় শহরে প্রশাসক নির্বাচন হয়েছে। শহরের সবচেয়ে সম্মানীয় ও কাজের মানুষকেই অনুরোধ করে মানুষ অনেকটা জোর করেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। প্রচারণা যা করার তা করেছেন ভোটাররা—প্রার্থী নিজে তাঁর বৈঠকখানায় বসে খামিরা তামাক কল্কেতে দিয়ে গুড়গুড়ি টানছেন। সেকালের মানুষ খোঁজ রাখতেন কোথায় কোন সমস্যা আছে। সেখানে গিয়ে তার সমাধান করতেন। নির্বাচিত হওয়ার পরে শহরে নাগরিক সুবিধা আরও কিছু বেশি কীভাবে করা যায় সে উদ্যোগ নিতেন। কিন্তু তাঁরা নির্বাচনের আগে প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতি মোটেই দিতেন না। তাঁরা সাধারণত সম্ভ্রান্ত মানুষ হতেন, তাই তাঁদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মুখে আসত না, যা তাঁদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

অবশ্য সেকালের পৌরসভা আর এখনকার নগর করপোরেশনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তখন শহর ভৌগোলিক আকারে শুধু নয়, পৌর এলাকায় জনসংখ্যাও ছিল কম। এখন নগর একেকটি সাম্রাজ্য। এগুলোর মেয়রদের নগরপিতা না বলে বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে নগরসম্রাট বললে বেমানান হবে না। বড় মাদক ব্যবসায়ীকেও তো আমরা মাদকসম্রাট বলে আখ্যায়িত করি।

পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত ছিল। তাদের কাজ ছিল সরকারের সঙ্গে দেনদরবার এমনকি ঝগড়া করে হলেও বেশি বরাদ্দ আনা। সরকারের পোঁ ধরা নয়। ষাটের দশকে আইয়ুবীয় মৌলিক গণতন্ত্রের সময় থেকে তাতে সরকারি দলের প্রভাব পড়ে। দুর্নীতিরও তখন থেকেই শুরু। তখন দুর্নীতির পরিমাণ ছিল কম। টেস্ট রিলিফের গম কিছুটা এধার-ওধার করা। তাকেই মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য বিরোধী নেতা ‘গম চোর’ আখ্যায়িত করতেন। স্বাধীনতার পরে স্থানীয় সরকার সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, আশির দশক থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন সরকারের একান্ত অনুগত কর্মচারী।

জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আর সরকারি কর্মকর্তা যে একেবারেই এক জিনিস নয়, তা বোঝার ক্ষমতা যে জনপ্রতিনিধির নেই—তার পক্ষে ওই পদে সঠিক দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। সব শহরই কোনো না-কোনো জেলা বা উপজেলার অন্তর্গত। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রয়েছেন। তাঁরা সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের বাইরে একজন মেয়রের দরকার কী? তাঁরা সরকারের প্রতিনিধি, মেয়র নাগরিকদের প্রতিনিধি। পিতার গুরুদায়িত্ব পালনের দরকার নেই, প্রতিনিধির দায়িত্বটুকু সুষ্ঠুভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করলেই যথেষ্ট।

বাংলাদেশ মডেলের গণতন্ত্রে নির্বাচনী প্রচারটাই এখন প্রধান। কীভাবে ভোট হলো সেটা গৌণ। সম্ভাব্য নগরপিতার সুযোগ্য ক্যাডারদের নিরিবিলিতে বসে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সিল মারাটা দোষের নয়। সাড়ে চার শ বছর পরে গত রোববারই আমরা নির্বাচন কমিশন থেকে জানতে পারলাম ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের সঠিক সংজ্ঞা নেই’। আসল কথা হলো কোনো ‘সঠিক সংজ্ঞা’ ছাড়াই বিশ্বব্যাপী নির্বাচন হচ্ছে, বাংলাদেশেও কখনো হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞা অবশ্যই আছে, সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনে সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না।

দলীয় মনোনয়নে এবং দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দোষের নয়। অকারচুপি অথবা কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়রের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত দলের সব পদ থেকে তাঁর পদত্যাগ করা। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য থাকবে, সরকারের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক, দলের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা। কারণ, তিনি নগরের সব মানুষের অভিভাবক। নিজের দলের কর্মসূচিতে যোগ দিলে অন্য দলের কর্মসূচিতে যদি আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁর তাতে যোগ দেওয়া উচিত। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি তাই? বিরোধী দলকে ঠেঙালেই তো একজনের বড় যোগ্যতা।

দলীয় নগরবাবারা যে তরিকাতেই নির্বাচিত হোন না কেন, নির্বাচনের পরে তাঁরা যদি নিরপেক্ষভাবে ভালো কাজ করেন—তাহলে তাঁর নিজের দলেরই উপকার হয়। দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে নিজের দলের সুনামের জন্য নয়, নগরীর উন্নয়নের জন্যও নয়, নিজের ভাগ্য উন্নয়নে ব্রতী হতে দেখা যায় অনেককে। নগর পড়ে থাকে অভিভাবকত্বহীন। বাংলাদেশের প্রতিটি পৌর এলাকা আজ সৌন্দর্যহীনতার প্রতীক।

আমরা প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশের মানুষ। শহর ও নগর সভ্যতা কাকে বলে তা আমরা জানি না। না জানার ফলে সম্পূর্ণ কারচুপি ছাড়া ‘চমৎকার নির্বাচনে’র মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও পৌর এলাকার উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। পৌর এলাকাগুলো আকারে ছোট হওয়ায় সেখানেই সুন্দরভাবে কাজ করা সম্ভব। পৌরসভা নির্বাচন কোনো উৎসব নয়। খেলাধুলার টুর্নামেন্ট নয়। মিডিয়া ঢাকঢোল পিটিয়ে যে প্রচার দেয় তাতে জনবিচ্ছিন্ন দলবিশেষের উপকার হতে পারে, জনগণের এক ছটাক লাভ নেই। জনহিতকর কাজই আসল, জাঁকজমকের প্রচারণা নয়।

একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে স্বশাসিত ও দক্ষ স্থানীয় সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নষ্ট রাজনীতির প্রভাবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাও নষ্ট হয়ে গেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেলে উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক