জনতুষ্টিবাদের জনপ্রিয়তায় চিড় ধরাবে দুর্নীতি

নাজিব রাজাক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
নাজিব রাজাক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

সম্প্রতি দুনিয়াজুড়ে নির্বাচনে জনতুষ্টিবাদীদের জয়জয়কার দেখে অনেকেই এটিকে উদার গণতন্ত্রের ওপর বিরাট আঘাত বলে অভিহিত করছেন। তাঁরা মনে করছেন, হয়তো জনতুষ্টিবাদের তোড়ে উদারপন্থী সরকারব্যবস্থা বিলীন হয়ে যাবে। তবে কয়েক দিন আগে মালয়েশিয়ার সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই ধারণা যেন একটু হোঁচট খেয়েছে। জনগণ আর যা-ই হোক, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে যে চায় না, সেটি মালয়েশিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে।

এখনো অনেকে মনে করছেন, আদর্শিক কারণে উদার গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে লোকজন স্বৈরতান্ত্রিক নেতাদের সমর্থন দিচ্ছে; আদর্শিক কারণেই তারা গণতন্ত্র, উদারপন্থা, মানবাধিকার ইত্যাদিকে প্রত্যাখ্যান করছে। এই ধারণা স্পষ্টতই ভুল। মানুষের মধ্যে আদর্শিক চেতনার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও নিরাপত্তার অনুভূতি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার উদার মানসিকতার মানুষও এখন মনে করা শুরু করেছে, উদারপন্থী নীতি তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রক্ষণশীলেরা তাদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছে, মানবাধিকারের মতো ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে গেলে শরণার্থী সংবেদনশীল চেতনায় আটকে থাকলে ব্যক্তিগতভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। উদারপন্থীরা সেই যুক্তি খণ্ডন করার মতো উদাহরণ তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। জনতুষ্টিবাদের উত্থানের পেছনে এটি একটি বিরাট কারণ।

তবে মালয়েশিয়ায় নাজিব রাজাকের পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের উদারপন্থীদের সামনে একটি বড় শিক্ষা দিয়ে গেছে। যেসব দেশে এখন জনতুষ্টিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, দুর্নীতি ইস্যুকে সামনে রেখে এগোলে সেখানে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যেসব দেশের নেতারা বঞ্চনার শিকার হওয়া মানুষের জনতুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন বা হঠাৎ করেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির বড় ধরনের অভিযোগ আছে। উদারপন্থীদের এমনিতেই নানা ব্যর্থতা আছে। সেই ব্যর্থতায় জনগণ রুষ্ট হয়ে আছে। এর বাইরে উদারপন্থীরা জনগণের কাছে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ ঠিকমতো তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে।

হাঙ্গেরিতে সম্প্রতি নির্বাচিত রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি ঋণ নিয়ে ঠিকাদারির মাধ্যমে ধনিকশ্রেণিভুক্ত হয়েছেন। তাঁর নিজের জন্ম হয়েছে যে শহরে, সেই শহরের মোট জনসংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৬০০ জন। অথচ সরকারি টাকায় ভিক্তর সেখানে ৪ হাজার লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্টেডিয়াম বানাচ্ছেন।

তুরস্কের নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও কোটি কোটি ডলারের অনিয়মের অভিযোগ আছে।

নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকজন সরকারি বিনিয়োগ তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি ডলার লোপাট করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব স্বচ্ছ নয়। তাঁর অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া ইতিমধ্যেই গুঞ্জন উঠেছে, তিনি এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, যাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ আছে।

উদারপন্থীরা যদি জনতুষ্টিবাদীদের এসব দুর্নীতির চিত্র সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে, তাহলে খুব দ্রুত জনগণ উল্টো ঘুরে যাবে। জনগণ নিজেদের বঞ্চিত মনে করার কারণে উদারপন্থীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। জনতুষ্টিবাদীরাও যখন তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না এবং তাদের দুর্নীতির কথা সামনে আসবে, তখন জনগণ তাদের দূরে ছুড়ে ফেলবে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকার স্বার্থ আগে’ স্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে আমেরিকার জনগণ ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখন তাঁর নীতির কারণে আমেরিকা ক্রমে একা হয়ে পড়ছে। এটি অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে জনতুষ্টিবাদকে কাজে লাগানো ট্রাম্পের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে চীন সরকার দুর্নীতি দমন অভিযান দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন অভিযানের মধ্য দিয়ে একদিকে জনগণকে বোঝানো হচ্ছে, এটি জনবান্ধব প্রশাসন; অন্যদিকে এই অভিযানের মাধ্যমে বিরুদ্ধ মতের লোকজনকে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে যেহেতু উদারপন্থীদের অবস্থান সেখানে নেই বললেই চলে, সেহেতু সেখানে অবস্থার পরিবর্তন খুব শিগগির হবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জেমস এ গোল্ডস্টোন মানবাধিকার সংগঠন ওপেন সোসাইটি জাস্টিস ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক