সমন্বিত পরীক্ষা বা কেন্দ্রীয় রুটিন কেন নয়?

সামনে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছে; দিন-রাত কোচিং চলছে। পরীক্ষার তারিখ ওভারল্যাপিং হবে কি না, পছন্দের বিষয়গুলোতে পরীক্ষা দিতে পারবে কি না—এসব বিষয়ে পরীক্ষার্থীরা যেমন শঙ্কায় আছে, তেমনি চিন্তিত সাধারণ অভিভাবকেরাও, কী হবে তাঁদের সন্তানদের, টাকাপয়সার সংকুলান হবে তো, পরীক্ষা শেষ করে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে তো। অভিভাবকদের ভাবনার যেখানে অন্ত নেই, সেখানে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা কী ভাবছেন, তা এখনো কেউ জানতে পারছেন না।

বেশ কয়েক বছর ধরে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি, আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে। প্রতিবছরই শোনা গেছে, ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিতভাবে অনুষ্ঠিত হবে। তবে এবার এখনো পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছু শোনা যায়নি। গত ১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয় নিয়েই উপাচার্যদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আলোচনা-পরামর্শ চলছে বলে শোনা যায়।

 শোনা যাচ্ছে, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি ঠেকাতে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে কি এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওতায় থাকবে না? তাহলে ভর্তি পরীক্ষা কি আগের মতোই হবে? পরীক্ষার্থীরা কি আগের মতোই ছুটবে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু আছে, তাতে দেখা যায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে, এমনকি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভর্তি পরীক্ষার তারিখ একই দিনে হলে পরীক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ে। এ ছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরপর থাকায় বেশি দূরত্বের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের বিষয়টিতে ভর্তি হতে পারে না, এমন বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়, যা সে পড়তে চায়নি। এতে তারা উদ্দীপনা হারায়। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার যোগ্যতা সাপেক্ষে সব ভর্তি পরীক্ষার অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। যোগাযোগব্যবস্থার দুরবস্থা ও অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে কাজ করে। তাই গতানুগতিক পদ্ধতিতে এবারও ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। নারী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এটা বেশি অসুবিধাজনক। ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী ঢাকায় অবস্থিত বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর সময় বা দূরত্ব বিবেচনা করে প্রায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা তাদের অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে (প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭)।

কেন্দ্রীয়ভাবে গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষার বিষয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক সুপারিশ এসেছে। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে এটি বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হবে না। তবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে যে বিষয়গুলো আসতে পারে সেগুলোর প্রথমেই বলতে হয়, কে এই দায়িত্ব নেবে? সুনির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, নাকি বিষয়ভিত্তিক কোনো কমিটি? বিপুলসংখ্যক ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর ভর্তির কাজগুলো (প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, প্রিন্টিং, প্যাকেজিং ও সরবরাহ) কারা করবে, কোথায় করবে? মনিটরিং কে করবে? বিশেষ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজগুলো দিতে অন্যরা রাজি হবে কি না? রাজি হলেও তাদের সেই সক্ষমতা আছে কি না—এসব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এ ছাড়া প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা করতে হলে বা সক্ষমতা বাড়াতে হলে বাড়তি খরচ দরকার। এক বিশ্ববিদ্যালয় একবার দায়িত্ব পেলে পরের বছর আরেক বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে সেখানেও একইভাবে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশাল এ কর্মকাণ্ডের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি থেকে যাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমের মূল্য ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ফির মধ্যে সামঞ্জস্য নিয়ে আসা উচিত। এসব কিছু বিবেচনায় ইউজিসিকে কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্ব দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে।

কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চীন, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ বিশ্বের অনেক দেশে আছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনেক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত পরীক্ষার পদ্ধতি চালু করতে না পারলেও অন্ততপক্ষে দেশের ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় রুটিন এমনভাবে করা যায়, যাতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি না হয় এবং তারা যোগ্যতা অনুযায়ী পছন্দের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সব বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।

মো. সহিদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক