এই অস্থির সময়ে বড় দরকার ছিল তাঁর

নেলসন ম্যান্ডেলা জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯১৮—মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ২০১৩
নেলসন ম্যান্ডেলা জন্ম: ১৮ জুলাই ১৯১৮—মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ২০১৩

লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানবতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বকালের এক উজ্জ্বল নাম নেলসন রোলিহলাহলা ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩)। তিন শব্দের এক নাম—নামের মাঝের ‘রোলিহলাহলা’ শব্দটা তাঁর নামের সঙ্গে তেমন
যায় না—শব্দটার ইংরেজি ভাষান্তর ‘ট্রাবলমেকার’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘সংকট কিংবা সমস্যা সৃষ্টিকারী’। কী
অদ্ভুত বৈপরীত্য—তৃতীয় বিশ্বের নিম্নবর্গের মানুষের
বহুমাত্রিক সংকট, সমস্যা, বৈষম্য দূর করার জন্য
পৃথিবীতে যাঁর আবির্ভাব, তাঁরই নামের একটা অংশের অর্থ ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’।
লেখক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার চিন্তক হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর মানুষের কাছে অতি শ্রদ্ধেয় এক নাম। দক্ষিণ আফ্রিকার ভূগোল পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন বিশ্ব-ভূগোলে, যেখানেই জাতিগত বা বর্ণগত বৈষম্য, সামাজিক অসমতা—সেখানেই সাধারণ মানুষের কাছে প্রেরণার এক দীপ্র নাম ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলা শব্দটাই এখন বিশ্বশান্তির প্রতীকে পরিণত, ম্যান্ডেলা নামটাই এখন সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ-আধিপত্যবাদ আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক বিস্ফোরক সংকেতে রূপান্তরিত।
জন্মশতবর্ষের এই শুভার্থী মুহূর্তে নেলসন ম্যান্ডেলার কর্মময় জীবনের দিকে তাকালে সাহস ও সংগ্রামের অনেক অনুষঙ্গ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তাঁর কর্মময় জীবনের অনেক অনুষঙ্গ ও প্রবণতা আমাদের জাতির অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য অতি জরুরি ও প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারে। প্রথমেই মনে আসে ম্যান্ডেলার সাহস, সংকল্প আর ত্যাগের কথা।
জীবনের ২৭টি বছর তিনি বিভিন্ন কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন—শ্বেতাঙ্গ মানবতার চোখে ‘অস্পৃশ্য ঘৃণ্য কালোদের’ জন্য যুদ্ধ করেছেন—বঞ্চিত মানুষের মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিসর্জন দিয়েছেন নিজের স্বার্থ। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্ম
করে নিয়েছিলেন। তিনিই কৃষ্ণ-আফ্রিকার শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা।
শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে কালো আফ্রিকাবাসীর চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক মূল্য চেতনা, শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা, বর্ণবৈষম্য দূর করা এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা—
এই চতুর্মাত্রিক বৈশিষ্ট্যই নেলসন ম্যান্ডেলার জাতীয়তাবাদের মূল কথা।
ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে ম্যান্ডেলা হয়ে উঠেছেন আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে তিনি কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাই নন, হয়ে উঠেছেন গোটা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের নেতা। তাঁর আপসহীন সংগ্রাম আর নির্ভীক নেতৃত্বের কারণেই ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ তাঁকে সে দেশের প্রথম
কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। শান্তি প্রতিষ্ঠায়
তাঁর নিরলস প্রয়াস ও সাধনার জন্য তিনি অর্জন করেন নোবেল পুরস্কার।
নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। তাত্ত্বিক আর বুদ্ধিজীবীর জটিল চারিত্র্য তাঁর রাজনীতিচেতনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ এবং অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যা বুঝতেন, তা-ই ছিল তঁর রাজনীতিভাবনার কেন্দ্রীয় উৎস। ম্যান্ডেলার আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদেরও অপূর্ব মিলন ঘটেছে।
নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম বইয়ে একটা পরিষ্কার
ধারণা দিয়েছেন। সন্ত্রাস-সংঘাত দিয়ে নয়; বরং আইনি বিপ্লব দিয়ে ম্যান্ডেলা সব ধরনের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের
কথা বলেছেন।
অবশ্য প্রথম জীবনে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সন্ত্রাসের পথ, কিন্তু উত্তরকালে সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগ করে সমঝোতা ও আলোচনার পথকেই রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের সামূহিক মুক্তির কথা ভেবেছেন; কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই হারাননি তাঁর স্বচ্ছ মানবতাবোধ।
আফ্রিকায় ম্যান্ডেলাকে বলা হয় গণতন্ত্রের মানসপুত্র। গণতন্ত্রের প্রতি ম্যান্ডেলার আস্থা ছিল অবিচল। কোনো প্রসঙ্গে নিজের মতকেও তিনি গ্রাহ্য করতেন না, যদি দেখতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভিন্নমতের কথা বলছেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে গণতান্ত্রিক মূল্য চেতনার বিকাশ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পাশাপাশি নেলসন ম্যান্ডেলা মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষার প্রতিও গভীর আগ্রহী ছিলেন। মার্ক্সের মতবাদের প্রেরণাতেই তিনি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন
দেখতেন এবং সে ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনব্যাপী যুদ্ধ করেছেন।
ম্যান্ডেলা মার্ক্সীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং বিপ্লবের জন্য তিনি সব সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সাম্যবাদী, কিন্তু
কখনোই কট্টর কমিউনিস্ট নন। মার্ক্স-লেনিনের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও, তিনি চলতেন নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাসের আলোকে। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে রূপ দিতে ম্যান্ডেলা ছিলেন সদা সচেষ্ট। ম্যান্ডেলার কাছে রাজনীতি ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধক্ষেত্র।
রাজনীতির মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ম্যান্ডেলার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে মানবাধিকার প্রসঙ্গ।
দক্ষিণ আফ্রিকার অনুসরণে অন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কূটনীতি এবং সংলাপের মাধ্যমে নিরসনের জন্য ম্যান্ডেলা পৌনঃপুনিক ডাক দিয়েছেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনেও ম্যান্ডেলার ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর মানুষের কাছে মুক্তির দূত হিসেবে পরিচিত। মানবমুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। নানামাত্রিক শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার বিদ্রোহী।
শত প্রতিকূলতা আর অত্যাচার-নির্যাতন করেও শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা তাঁকে বিপথগামী করতে পারেনি। একজন লেখক হিসেবেও তিনি রেখে গেছেন অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্বদেশিরা মাদিবা নামেই চেনে এবং জানে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষের এই শুভার্থী মুহূর্তে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি জ্ঞাপন করি। পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের কাছে আশা ও আশ্বাস, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের একটি প্রতীকী নাম নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁকে জানা এবং তাঁর পথ অনুসরণ করা আমাদের নিজেদের স্বার্থে জাতীয় প্রয়োজনে অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ।

বিশ্বজিৎ ঘোষ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য