আগে সরষের ভূত তাড়াতে হবে

সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সুরক্ষা সেবা) মো. ফরিদ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছেন, এই অভিযান কত দিন চলবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। একটি টেকসই পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত চলবে।

‘টেকসই’ বলতে ঠিক কী রকম পর্যায়, সেটা উল্লেখ না করলেও, অনুমান করি, দেশে মাদকের যে ভয়াবহ বিস্তার ও ব্যবহার নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন, তা সম্পূর্ণ নির্মূল করা যদি সম্ভব না-ও হয়, অন্তত মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে দৃঢ় অবস্থান নিতে চায় সরকার। এ অভিযানের ‘সীমাবদ্ধতা’র নানা দিক সম্পর্কে তিনি বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবগত, সেটাও বোঝা গেল তাঁর বক্তব্যে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘গডফাদার’রা অধরা থেকে যাচ্ছেন—গণমাধ্যম বা নাগরিক সমাজের এ অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর দ্বিমত আছে বলেও মনে হলো না। বরং ১৯৯০ সালে প্রণীত আইনের দুর্বলতা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, গডফাদারদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন করা হবে। আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য উঠতে পারে বলেও আভাস দিলেন তিনি।

সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এযাবৎ কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন প্রায় ১৯০ জন। এ কথা মানতেই হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা যতই সোচ্চার হোন না কেন, জনসাধারণের মধ্যে এ অভিযানের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল শুরু থেকেই। মাদকের সর্বগ্রাসী প্রভাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা দৃঢ় অবস্থান দেখতে চেয়েছেন তাঁরা। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশে এ ধরনের অভিযানের ফলে মাদকের ব্যবহার হ্রাস ও সমাজে সাময়িক স্বস্তি ফিরে আসার নজির আছে। ফলে মানুষ আশান্বিত হয়েছিল।

কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা চলমান অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার পর মানুষের আস্থার জায়গাটিই যেন টলে গেল। একরাম নিহত হওয়ার আগমুহূর্তের কথোপকথন ও ওই সময়ের পরিস্থিতির একটি অডিও টেপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। ‘গডফাদার’ প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসে জোরেশোরে। যাঁরা ধরা পড়ছেন বা নিহত হচ্ছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’, তাঁরা প্রকৃত অপরাধী কি না বা অপরাধী হলেও কোন স্তরের, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। খুচরো মাদক বিক্রেতা বা বাহকের মতো চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও প্রকৃত অপরাধী (গডফাদার) থেকে যাচ্ছেন পর্দার অন্তরালে, এমন একটি ধারণা জন্মেছে জনমনে।

এ মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও বিপজ্জনক মাদকদ্রব্যটির নাম ইয়াবা। ওষুধের ছোট বড়ির আদলের এই নেশাদ্রব্য আসে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চল হয়ে। সহজে বহনযোগ্য, অথচ বিক্রয়মূল্য বেশি বলে নানা হাত ঘুরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্ধার করা লাখ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধারের সংবাদ পত্রপত্রিকায় দেখে বোঝা যায় দেশে এর চাহিদা কী রকম! একসময় নেশাদ্রব্য হিসেবে ভারতে উৎপাদিত ফেনসিডিলের বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছিল। সীমান্তের আশপাশের এলাকায় (ভারতীয় অংশে) গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু ফেনসিডিল তৈরির কারখানা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ভারতকে অবহিত করা হয়। কারখানাগুলোর তালিকা ও অবস্থান জানানোর পর সেগুলো উচ্ছেদ করার ফলে নেশাদ্রব্যটির প্রচলন এখন অনেকটাই কমেছে। কিন্তু মিয়ানমার থেকে এ ধরনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়াবার মতো ‘লাভজনক’ মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বন্ধের ব্যাপারে সম্ভবত সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীরই অনীহা আছে।

আমাদের দেশেও ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারটি ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, সরষের ভেতর ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে? স্বরাষ্ট্রসচিবের মতবিনিময় সভাতেও কথাটি উঠেছে। এ অভিযোগ সম্পর্কে তিনি
বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

কিন্তু বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এ বক্তব্যের গরমিল আছে। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা পুলিশের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁদের দায়িত্বে বহাল থাকার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ১০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে জব্দ তালিকায় মাত্র ১০ হাজার দেখিয়ে বাকি ৯ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে জেলা পুলিশের একটি দল। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে জেলা পুলিশ সুপার, দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ ১২ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ প্রশাসন (প্রথম আলো, ২২ জুলাই)।

মাদক নির্মূলের জন্য কক্সবাজার ও বান্দরবানকে আলাদা জোন হিসেবে চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব। সেই ‘আলাদা জোনে’র পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত সুপারই যদি মাদক ব্যবসার অংশীদার হয়ে পড়েন, তাহলে কর্মপরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই। দুই কর্মকর্তার বিরোধের কারণে এ ঘটনা ফাঁস হয়েছে। তাহলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সংঘটিত এ রকম আরও ঘটনা যে
আমাদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে, তা-ও তো অনুমান করা যায়।

মাদক ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা নানা সূত্র থেকে জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তার মধ্যে একটিতে নাম এসেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানার পাঁচজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নাম। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তাঁদের তিনজন বহাল তবিয়তে আছেন আগের কর্মস্থলে, দুজনকে বদলি করা হয়েছে অন্য থানায়। অন্যদের ক্ষেত্রে কঠোর
হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেলায় নমনীয় মনোভাব দেখালে মাদকবিরোধী অভিযানের সাফল্য নিয়ে সংশয় দূর হবে না। এ অভিযানের নির্দিষ্ট ‘সময়সীমা’ নেই বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু সরষের ভেতর থাকা ভূত না তাড়ালে অনন্তকালেও অভিযানের সাফল্য আসবে বলে
মনে হয় না।

গুরুপাপে লঘুদণ্ড দিলে এর ফল কী হতে পারে, এর একটি উদাহরণ আছে হাতের কাছেই। বাকলিয়া থানার একজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইয়াবাসহ ধরা পড়েছিলেন ২০১৬ সালে। তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। নিয়মানুযায়ী তিনি অর্ধেক বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। কিন্তু এই সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায়ই এ বছর জুলাই মাসের শুরুতে তাঁকে আবার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। বিচার প্রলম্বিত হলে যে প্রকারান্তরে বিচার অমান্য করা হয়, এ ঘটনা তার প্রমাণ।

মিয়ানমারের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা আছে আমাদের। স্বরাষ্ট্রসচিব বলেছেন, নদীপথের সবখানে পাহারা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে নাফ নদীতে ৬২ কিলোমিটার ও সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চিন্তাভাবনা চলছে। এ ছাড়া কিছু পথে ডিভাইস বসানো হবে বলেও জানালেন তিনি।

মাদক চোরাচালানের পথ রুদ্ধ করতে এসব উদ্যোগের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এতকাল ধরে মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর একাংশের সহযোগিতায় টেকনাফে যে ইয়াবার চালান আসছে, তা প্রতিরোধে আমাদের বিজিবি বা কোস্টগার্ডের দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথিল্য বা অবহেলা আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশের গুটিকয় দুর্নীতিবাজ সদস্যের মতো এখানেও কেউ কেউ মাদক পাচার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন কি না, তারও খোঁজ নেওয়া দরকার।

মাদকবিরোধী অভিযান চলুক, মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক দেশ ও সমাজ, এটা সবাই চান। কিন্তু অভিযান যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁদের সততা নিশ্চিত করা না গেলে পুরো ব্যাপারটা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোতে পরিণত হতে বাধ্য।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক