ক্ষুধায় মৃত্যু এক করুণ সত্য

ভারতের ইতিহাসের পাতায় শিখা, মানসী বা পারুলের নাম কখনোই লেখা হবে না। কেনই-বা তাদের নাম লেখা হবে? ইতিহাসের পাতায় তো কেবল নায়ক, খলনায়কদের ঘটনাবলি লেখা হয়। সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা তো ইতিহাসের বইগুলোতে স্থান পায় না।

আপনারা হয়তো এটা জেনে অবাক হবেন যে আমি সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের কথা বলছি। আমি আপনাদের জানাতে চাই, দিল্লির মান্ডাওয়ালি এলাকায় গত সপ্তাহে তিনটি মেয়ে মারা গেছে, যাদের বয়স যথাক্রমে ৮, ৪ ও ২ বছর। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেছে, তাদের কারও পাকস্থলীতে একদানা খাবার ছিল না। অর্থাৎ তারা অনেক দিন ধরে কোনো খাবার খায়নি। আপনারা ভালোভাবেই কল্পনা করতে পারবেন যে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো তাদের কেমন কেটেছে। ক্ষুধা শব্দটির আভিধানিক অর্থ তারা হয়তো জানত না, কিন্তু এই ক্ষুধার কারণেই তারা তাদের জীবন হারিয়েছে।

যখন এই মেয়ে তিনটি ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিল, তখন তাদের ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ মা-ও ছিলেন। মানসিক অসুস্থতা ও ভাষাগত সমস্যার কারণে তিনি তাঁর প্রতিবেশীদের কাছে যে সাহায্য চাইবেন, সেটিও পারেননি। তাদের বাবা মঙ্গল সে সময় কাজের সন্ধানে রাজধানীর পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

মঙ্গলের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে। দুই বছর আগে তিনি কাজের সন্ধানে সপরিবার দিল্লি আসেন। অন্য কোনো কাজ না পেয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তাঁর রিকশাটি ছিনতাই হয়। এতে একদিকে যেমন তাঁর আয়রোজগার বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে রিকশার মালিক তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। আবার কয়েক মাসের বাড়িভাড়া বাকি পড়ায় বাড়িওয়ালা তাঁকে উচ্ছেদ করেন।

কে বলে যে রাজধানী গোটা দেশের মানুষের দেখভাল করে? আরও কয়েকটি প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে খচখচ করছে। এটাই কি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির আসল চেহারা? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনের বাস্তবতা হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা বাধ্য হচ্ছে অন্য রাজ্যে চলে যেতে। কখন কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলো এসব বিষয়ে কথা বলবে? কোনো মানুষ আর ক্ষুধায় মারা যাবে না, এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নেবেন কোন রাজনীতিক? সম্প্রতি কয়েকজন সাংসদ বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছিলেন, কিন্তু সেটা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। কেন আমাদের সম্মানিত আইনপ্রণেতারা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হন না?

যদিও মঙ্গল ও তাঁর পরিবার না মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী, না তারা কাশ্মীর থেকে আসা উদ্বাস্তু, তবু কারও সময় নেই তঁাদের দুর্দশার দিকে নজর দেওয়ার। যেসব চিকিৎসক ওই তিন মেয়ের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন, তাঁরা এটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন যে তাদের শরীরে এতটুকু চর্বি অবশিষ্ট নেই।

অর্থাৎ পেটে কোনো খাবার না পড়ায় শরীরে যেটুকু চর্বি ছিল, তা তাদের কিছুদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। চর্বি ফুরিয়ে গেলে মেয়েরা কোমায় চলে যায়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এই মেয়ে তিনটি মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছিল, যে কারণে তাদের ত্বকের নিচে হাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কেন এই শিশুদের এমন করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো?

যখন আমি এই লাইনগুলো লিখছিলাম, তখন মঙ্গল আত্মগোপনে। শিশু তিনটি না খেতে পেয়ে মারা গেছে, এটা ভালো করে জানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ আরও একবার ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেয়। না, এ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

আমরা জানতে চাই, যারা মঙ্গলের রিকশা চুরি করেছিল, তারা কি শাস্তি পেয়েছে? বলা হচ্ছে যে মঙ্গল মাদকাসক্ত ছিলেন। কিন্তু যারা তাঁকে
মাদকের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব কার? দারিদ্র্য আপনাকে নানাভাবেই হত্যা করতে পারে।

এটা সত্য যে এই দেশে প্রতিদিন তিন হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। আমি বলতে চাই, অপুষ্টি আর ক্ষুধার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। কিন্তু সরকার জনগণকে এটা বলতে ভয় পায় যে এ দেশে ক্ষুধায় মৃত্যু হওয়াটা একটি চরম সত্য। এ কারণে কেউ ক্ষুধায় মারা গেলেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে সব সময় বলা হয় যে অপুষ্টিতে মারা গেছে।

এ দেশে এক হাজার শিশুর মধ্যে ৩৪ শিশুই মায়ের গর্ভে মারা যায়। স্বাধীন ভারতবর্ষের অর্থ বুঝতে পারার আগেই প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী ৯ লাখ শিশু মারা যায় এবং দেশের প্রায় ১৯ কোটি মানুষ খালি পেটে ঘুমাতে বাধ্য হয়। কালাহান্দি থেকে দিল্লি পর্যন্ত ক্ষুধা খুব দ্রুত একটি করুণ সত্যে পরিণত হচ্ছে। আমাদের সরকার কখন এ সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেবে?

ইংরেজি থেকে অনূদিত। হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া

শশী শেখর হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার এডিটর ইন চিফ