পেনশনজীবীদের বৈষম্য দূর করুন

বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা পেনশন-সুবিধা ভোগ করেন। এ সুবিধা ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে বিভিন্ন সংশোধনীসহ চলে আসছে। ইদানীং অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাই চালু করেছে পেনশনের ব্যবস্থা। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য খুবই সীমিত আকারে চালু হয়েছে এটি। তবে এ নিবন্ধ সরকারি পেনশনজীবীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য এবং তা দূরীকরণে কিছু প্রস্তাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

এগুলো নিয়ে পেনশনজীবীরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। খবরের কাগজের চিঠিপত্র কলামেও অনেক তথ্য আসে। সরকারের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। সময়ে সময়ে কিছু সমাধান হয়েছেও। তবে বড় একটি দিকই রয়ে গেছে অমীমাংসিত। ফলে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এর জন্য বিভিন্ন বিধিবিধানের দোহাই দেওয়া হয়। তবে কর্মরতদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নতুন বিধান দ্রুতই প্রণীত হয়। অবশ্য পেনশনজীবীরাও মনে করেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, বাজেটের আকৃতি ও দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় যতটুকু বেশি সম্ভব বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি কর্মরত চাকুরেদের পাওয়া উচিত।

সর্বশেষ বেতন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকেও অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন সচিবসহ এ নিবন্ধকারের আলোচনার সুযোগ হয়। তখন সবাই যতটা বেশি সম্ভব বেতন-ভাতা বাড়ানোর পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। কমিশন তা করেছেও খোলা হাতে। সরকারের সম্পদ বিবেচনায় একটি সচিব কমিটির সুপারিশে কিছুটা এদিক-সেদিক করে ২০১৫ সালে ২০০৯-এর বেতন স্কেল থেকে তা প্রায় শতভাগ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালেও ২০০৫-এর বেতন স্কেল থেকে প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ বেতন বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৫ সালে বেতন স্কেল নির্ধারণের সময়ে পরবর্তীকালে যাঁরা পেনশনে যাবেন, তাঁদের জন্যও রাখা হয় অধিকতর সুবিধা।

আগে পেনশন ধার্য হতো মূল বেতনের শতকরা ৮০ ভাগ ধরে। এবার করা হয়েছে শতকরা ৯০ ভাগ। আর এই পেনশনের অর্ধেক করতে হয় সমর্পণ। আগে প্রতি টাকার জন্য দেওয়া হতো ২০০ টাকা। এখন করা হয়েছে ২২০ টাকা। অথচ পেনশনভোগী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের পেনশন বাড়ানো হয় শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। সরকার উদারভাবে চাকরিজীবীদের সুবিধাদি বাড়িয়ে চলেছে। এখানে পেনশনবৈষম্য দূর করতে কিছু অতিরিক্ত টাকার সংস্থান করা যাবে না, এমনটা মনে হয় না।

অতিসম্প্রতি সরকারি চাকুরেদের বাড়ি তৈরি কিংবা ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ভর্তুকি সুদে বড় অঙ্কের ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পর্যন্ত বিনা সুদে গাড়ি কেনার টাকা দেওয়া হচ্ছে। নগদ দেওয়া হচ্ছে চালকের বেতন, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা। পেনশনজীবীরা এগুলো সবই সমর্থন করেন। বরং মনে করেন, সম্ভব হলে তাঁদের বেতনাদি আরও বাড়ানো উচিত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মাথাপিছু গড় আয় আমাদের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু অনেক বেশি চাকুরেদের বেতন। সে দেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সচিবেরা মাসে যথাক্রমে বেতন পান ২ লাখ ৫০ হাজার এবং ২ লাখ ২৫ হাজার রুপি। অবশ্য সরকার গত কয়েক বছরে একটি হতশ্রী অবস্থা থেকে আমাদের দেশের বেতন স্কেলও অনেক উন্নীত করেছে। প্রসারিত হচ্ছে সুবিধাদি।

পেনশনবৈষম্য সৃষ্টি হয় বেতন বৃদ্ধিজনিত কারণেই। ১ নম্বর গ্রেডের চাকুরেরা ২০০৫ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে বেতন পেতেন ২৩ হাজার ও ৪০ হাজার টাকা। সে হিসাবে তাঁদের মাসিক পেনশন নির্ধারিত হয় ৯ হাজার ২০০ ও ১৬ হাজার টাকা। এখন এই স্কেল ৭৪ হাজার টাকা। পেনশনে যাচ্ছেন মাসে ৩৬ হাজার ৯০০ টাকা নিয়ে। আর ২০০৫-এর আগে এই স্কেল ছিল ১৫ হাজার টাকা। তাঁদের পেনশন ৬ হাজার টাকা। ঠিক তেমনি সর্বনিম্ন ২০ তম গ্রেডে একজন কর্মচারী ২০০৯-এর স্কেলে বেতন পেতেন ৪ হাজার ১০০ টাকা। তাঁরা পেনশনে গেছেন মাসে ১ হাজার ৬৪০ টাকা নিয়ে। এখন বেতন ৮ হাজার ২০০ টাকা। পেনশনে যান মাসে ৩ হাজার ৬৯০ টাকায়। যাঁরা আগে পেনশনে গেছেন, তাঁদের পেনশন-পরবর্তী বেতন বৃদ্ধির সময়ে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে বিরাট বৈষম্য।

অথচ বয়স বাড়লে টাকার প্রয়োজন কমে না, বরং বাড়ে। চিকিৎসক, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধের ব্যয়ই মেটানো দুষ্কর এ পেনশনজীবীদের। অথচ একই পদধারীর একই পেনশন এ নীতি গ্রহণ করা হলে তা রাষ্ট্রের ভান্ডারের ওপর বড় কোনো চাপ পড়বে না। যাঁরা যে স্তর থেকে পেনশনে গেছেন বা যাবেন, তাঁদের একই পেনশন স্তরে নিয়ে এলে বৈষম্যটি থাকে না। বার্ধক্যে টাকার চিন্তার মতো বেদনাদায়ক আর কিছু নেই। কেউ পরনির্ভরশীল হতে চান না। আর চাইলেই কে কাকে দেয়? হয়তো বলা হবে, এরূপ সমতাকরণের কোনো নিয়ম নেই। আর নেই বলেই তো নিয়মটা করার দাবি। নিয়ম তো প্রায়ই বদলানো হয়। ২০১৫ বেতন স্কেল নিয়ে যাঁরা পেনশনে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্যও তো নিয়ম পাল্টানো হয়েছে।

আগে পেনশনজীবীরা রাষ্ট্রের অন্য কোনো লাভজনক পদে নতুনভাবে যোগ দিলে তাঁর বেতন থেকে পেনশনের সমপরিমাণ টাকা কেটে রাখা হতো। একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করলে ব্যবস্থাটি বেআইনি ঘোষিত হয়। একপর্যায়ে ২০০৮ সালে বাতিল করা হয় সে কেটে রাখার বিধানটি। সুতরাং চাইলে করা যাবে না, এমন কোনো বিষয় এটি নয়। পেনশনজীবীদের আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা বিপদগ্রস্ত হয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করেছিল। বিনিময়ে পায় ১০০ মাসের, অর্থাৎ ৮ বছর ৪ মাসের সমপরিমাণ পেনশনের টাকা। এ মেয়াদটা শেষ হলে তো পুনর্বহাল করা যায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। তাঁরা তখনকার প্রেক্ষাপটে এ সমর্পণের মাধ্যমে এককালীন যে টাকাটা পেয়েছিলেন, তা আজকের বিবেচনায় নগণ্য। সুতরাং বিধিবিধান কিছুটা পরিবর্তন করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার পেনশনজীবীদেরও হতে দিন। তাঁরা কিন্তু অন্যদের মতোই মুদ্রাস্ফীতিরও অংশীদার। এভাবে গোটা পেনশনের ব্যবস্থাটিকে দেখলে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের একটি অংশে বড় ধরনের ইতিবাচক ঝাঁকুনি পড়বে। ধারণা করা হয়, খুব বেশি ব্যয় এর পেছনে হবে না। আর পেনশনজীবী কিংবা তাঁর স্ত্রী বা স্বামী কিন্তু ক্রমান্বয়ে মরে যান। সুতরাং দায়টি বড় ধরনের ক্রমবর্ধমান হবে না।

সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে এটা সামনে আসবে না। বরং হিসাব-নিকাশ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এর সুফলসহ প্রস্তাবটি তুলে ধরলে সানন্দেই তাঁরা সম্মতি দেবেন বলে ধারণা করা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়কে প্রসারিত করার কোনো প্রচেষ্টায় সাধারণত রাজনীতিকদের থেকে বাধা আসে না। বিষয়টি বিধিবিধান পরিবর্তন-সম্পর্কিত বলে বর্তমান চাকুরেদের একটি অংশই এতে অনাগ্রহী হতে পারে। অথচ কয়েক বছর পর তারাও এ কাতারে এসে শামিল হবে, এটা চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করবে না।

ওপরের চেয়ে নিচের পর্যায়ে চাকুরের সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পেনশনজীবীও তাঁরাই বেশি। কী করুণভাবে তাঁদের দিন কাটছে, এ খবর কজন রাখেন। প্রস্তাবিত ব্যবস্থাগুলো সরকার নিলে তাঁরা ফিরে পাবেন নতুন জীবন। এককালীন সমর্পিত অঙ্কের যে বিরাট ব্যবধান, এটা পাওয়ার দাবি কেউ করছেন না। শুধু মাসিক পেনশনটার মধ্যে সমতা আর পুরো সমর্পণকারীদের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা করলে অনেক হবে। উদারভাবে বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি বৃদ্ধি সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে যাঁরা সারা জীবন সরকারকে সেবা দিয়ে আজ অবসরজীবী, তাঁদের দিকেও একটু বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। তাঁরা হিরা-মানিক চান না। একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র পূর্ণ করাই তাঁদের চাওয়া। এটুকু পূরণ করতে অর্থের সংস্থানের চেয়ে উদ্যোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]