রাজীব সৈনিক হতে চেয়েছিল

রাজীব সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিল, সে জন্য ফরম তুলে পূরণও করেছিল
রাজীব সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিল, সে জন্য ফরম তুলে পূরণও করেছিল

উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব (১৮) সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিল। সে সেনাকর্তা হতে চেয়েছিল। ফরম তুলেছিল। সেটা পূরণ করেছিল। হায়, তা জমা দেওয়ার আগেই সে চলে গেল সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। ২৯ জুলাই নিজের কলেজের সামনে বেপরোয়া দুই বাসের ধাক্কায় সে বরণ করেছে করুণ মৃত্যু। খুব ছোটবেলায় বাবা হারিয়েছিল সে। দুই ভাই আর দুই বোন তারা। ছোট ছোট চার সন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়ে যান মা। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কাজে সহযোগিতা করে সন্তানদের মানুষ করার সংগ্রাম করেন তিনি। হাতিয়ায় থাকেন নিজে, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন ঢাকায়। রাজীব থাকে খালাতো ভাই মেহরাজের আশকোনার বাড়িতে। তার ছোট ভাই আল আমিন পড়ে আশকোনা আদর্শ স্কুলে, ক্লাস সিক্সে; সে থাকে বোনের বাসায়। রাজীব পড়ে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় আবদুল করিম রাজীব পেয়েছে জিপিএ–৪.২। আর কটা দিন! এরপরেই তো সুদিন আসবে রাজীবদের পরিবারে! সে আর্মিতে যোগ দেবে।

আর্মিতে ঢুকবার জন্য পূরণ করা ফরমের কপি দেখিয়ে কাঁদেন রাজীবের মা। বুধবার সকালে হাতিয়া থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছেন তিনি। তারও আগের দিন হাতিয়া রেহানিয়া গ্রামে কবরে শুইয়ে দিয়েছেন তাঁর নাড়িছেঁড়া ধনকে। আশকোনায় ভাগনের বাড়িতে এসে সারাক্ষণই কাঁদছেন তিনি। বিলাপ করছেন। আমার প্রাণের পাখি, কই চলে গেল রে! আমি যখন এই বাড়িতে ঢুকলাম, আমাকে দেখে রাজীবের খালাতো ভাই মেহরাজ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী বলতে লাগলেন, নৌমন্ত্রী কীভাবে ভারতের দুর্ঘটনার তুলনা দেন? কেন তিনি এসব বলবেন? রাজীবের বোনেরা প্রশ্ন করে, বিচার কি হবে? এখনো তো চালক ধরা পড়ে নাই।

রাজীবের ছোট ভাই আল আমিন বাকহারা। তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও আল আমিন? আমি জিজ্ঞেস করি। খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে বলে, ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই আমি। আমিও আর্মিতে যোগ দিতে চাই। শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে যাই রাজীবের বাসা থেকে বেরিয়ে। সেখানে তার শিক্ষিকা মাহফুজা নাসরিন বললেন, চমৎকার একটা ছেলে ছিল রাজীব। মাহফুজা ম্যাডাম এখন অধ্যক্ষ হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহীতে। কিন্তু প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের এই ভীষণ বিপদের দিনে তিনি চলে এসেছেন স্কুলে।

একজন শিক্ষক পকেট থেকে একটা চকলেট বের করেন। সর্বশেষ পরীক্ষায় ভালো করেছিল রাজীব। খুশি হয়ে শিক্ষকদের প্রত্যেককে একটা করে চকলেট দিয়েছিল সে। শিক্ষকের পকেটে সে চকলেট রয়ে গেছে, রাজীব নেই। অধ্যক্ষ নূর নাহার ইয়াসমীন আমাকে তঁার টেলিভিশন মনিটর দেখান। দেখেন, এখান থেকে ওই রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। ১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী এখানে পড়ে, বাইরের কেউ কোনো দিন কোনো আওয়াজ পেয়েছে? ভীষণ ডিসিপ্লিনড ওরা। আমাদের শিক্ষার্থীরা কিন্তু রাস্তার ধারের ওই ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি একজন মা, আমি একজন শিক্ষক। আমি চাই, যে মা তার সন্তানকে আমার এখানে সুস্থ অবস্থায় পাঠিয়েছে, তার সন্তান তার কাছে সুস্থভাবে ফিরে যাক। আমার বাচ্চারা তো রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে ছিল।’

অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে ঘিরে ধরেন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কী হবে?

অধ্যক্ষ ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তঁারা খুবই সহযোগিতা করছেন। দশজন শিক্ষার্থী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। চারজন ছাড়া পেয়ে চলে গেছে। একজন আইসিইউতে আছে। প্রিয়াংকা। সে কথা বলে। আরেকজন আহত ছাত্র অধ্যক্ষকে বলেছে, সে মাথা তুলতে পারছে না। অধ্যক্ষ নিউরোর চিকিৎসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসেছেন।

শিক্ষকেরা বলেন, এই কলেজের শিক্ষার্থীরা খুবই সংগ্রামশীল জীবন যাপন করে। বেতনটা কম। সুবিধাবঞ্চিতদের ছাড়ও দেওয়া হয়। ফলে গাজীপুর থেকে মিরপুর থেকে বাসে ঝুলে শিক্ষার্থীরা আসে। কিন্তু ফল খুব ভালো। বাণিজ্যে এবার ১০০% পাস। সব মিলিয়ে ৯৮ ভাগ উত্তীর্ণ।

আরেকটা মারাত্মক কিন্তু খুবই জরুরি তথ্য জানা গেল। দুর্ঘটনাস্থলটা খুবই বিপজ্জনক। ওখানে প্রায়ই লোক মারা যায়। এই স্কুলের শিক্ষিকার সন্তান মারা গেছে, অভিভাবক মারা গেছে। ওখানে একটা পথচারী পারাপার সেতু ছিল, উড়ালসেতু হওয়ার পর তুলে দেওয়া হয়েছে। আর দিয়া ওরফে মিম মাত্র ২১ দিন কলেজ করেছে। ১ জুলাই ভর্তি হয়েছিল, ২৯ জুলাই মারাই গেল মেয়েটা।

 ‘আমাদের নতুন প্রজন্ম কী রকম সৃজনশীল! ফেসবুকে ওদের পোস্টগুলো দেখেছেন? ওদের পোস্টারের লেখাগুলো! এই প্রতিভাগুলোকে কি আমরা এইভাবে হারিয়ে ফেলব?’ প্রশ্ন তুললেন অধ্যক্ষ ইয়াসমীন।

 ‘অন্য সব মা যা চান, আমিও তাই চাই। আমিও তো মা।’ বললেন অধ্যক্ষ। ‘আমার সন্তান নিরাপদে যেন ঘরে ফিরতে পারে’।

 ‘শিক্ষার্থীদের জন্য দরকার কাউন্সেলিং আর মোটিভেশন। আমরা সব শিক্ষক ফোন করে করে শিক্ষার্থীদের বোঝাচ্ছি’—অধ্যক্ষ জানান।

এই কথাটা কি আমরা সরকারের কানে পৌঁছাতে পারব? এই শিশু–কিশোরদের দরকার কাউন্সেলিং। ওদের সহানুভূতি দিন। ওদের পাশে দাঁড়ান। ওদের বোঝান। ওরা রাস্তায় মার খাচ্ছে, এটা আমি সইতে পারছি না। যা বড়দের করার কথা, তা করার দায়িত্ব আমরা ছোটদের নরম কাঁধে তুলে দিয়ে নিরাপদ বেষ্টনীতে বসে স্ট্যাটাস দিচ্ছি কেন?

রাজীবের পরিবারের খোঁজ কেউ নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যায়নি তাদের কাছে। বাবাহারা, এখন ভাইহারা, আল আমিনের পড়াশোনার দায়িত্ব কে নেবে—কেউ তো খোঁজও নেয়নি। আমি বলেছি, কেউ না নিলে আমরা নেব। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

নিরাপদ সড়ক আমরা চাই। অন্যায় অপরাধ যে ঘটাবে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কিন্তু এটা শুধু দুদিনের মিছিলে হবে না। তারানা হালিম তঁার সন্তানসম স্বজনকে হারিয়ে বহুদিন রাস্তায় ছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন আছেন। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর পুরো দেশ আন্দোলনে নেমেছিল। প্রথম আলো দিনের পর দিন গোলটেবিল করেছে, একটার পর একটা সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেই যাচ্ছে। কিন্তু কিছু হচ্ছে কি?

সার্বিক নৈরাজ্যেরই লক্ষণ এসব। বিচারহীনতা, সুশাসনের সংকট। জবাবদিহি না থাকা। এবং গোষ্ঠীগত মাস্তানি। প্রতিবাদ হোক। প্রতিবিধান আদায় করে ছাড়া চাই। সরকারের কাছে মিনতি, দাবিগুলো মেনে শিশু–কিশোরদের ক্লাসে ফেরানোর উদ্যোগ নিন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক