নিষ্পাপ শিশুদের জয় হোক

দুজন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক অকালমৃত্যুর ট্র্যাজেডি সমগ্র জাতিকে স্পর্শ করেছে, ব্যথিত করেছে, প্রতিবাদী করেছে। এমন আন্দোলন কখনো দেখিনি। দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি। বিশ্ব ইতিহাসে স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেশব্যাপী এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নজিরবিহীন। যদি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, কিংবা ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা করতে চাই, তবু এ আন্দোলন নানা কারণেই অভূতপূর্ব। প্রথমত, এ আন্দোলন গড়ে তুলেছে স্কুল-কলেজে পড়ুয়ারা, আইনি ভাষায় যারা নিষ্পাপ শিশু। এ আন্দোলনের মূল সুর দুটি—প্রথমত, নিরাপদ সড়ক, যা সমগ্র জাতির প্রাণের দাবি; এবং দ্বিতীয়ত, আইনের যথার্থ প্রয়োগ। গত প্রায় এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা তো বটেই, সারা দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে রাস্তায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় এবং আইন প্রয়োগ করলে আমাদের এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কী নিদারুণ রূপ বেরিয়ে আসে।

এ দেশের সড়ক ও নৌপথ বহুকাল ধরেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। কেউই তাকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ। সবাই একমত, সড়কে সীমাহীন যে নৈরাজ্য তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম এই জীবননাশ। একে দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া যায় না, সবই হলো ইচ্ছাকৃত মানুষ হত্যা। এবং এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে সক্রিয় এক শ্রেণির মুনাফালোভীর ক্ষমতার দম্ভ। সে দম্ভের বহিঃপ্রকাশ এক শ্রমিকনেতা-কাম-মন্ত্রীর হৃদয়হীন দন্তবিকশিত হাসির ফোয়ারা। তাঁর পদত্যাগ তাই এই নিরপরাধ শিশুদের অন্যতম প্রধান দাবি।

প্রতিদিন এ দেশে বেঘোরে প্রাণ দেয় মানুষ, কেউ বা বাকি জীবন পঙ্গু হয়ে থাকে; গোটা পরিবার পথে বসে; কিন্তু কোনো প্রতিকার হয় না। প্রতিকার হয় না দেখতে দেখতে একসময় চেতনা বিবশ হয়ে যায়, গা সওয়া হয়ে যায়। রাস্তায়, বাড়িতে, দোকানে কোথাও মানুষের নিরাপত্তা নেই। ঘাতক যন্ত্রদানব যে কারও প্রাণপ্রদীপ মুহূর্তে নিভিয়ে দিতে পারে, আর সে জন্য কাউকে কারও কাছেই কৈফিয়ত দিতে হয় না, কারও গদি টলে না; বরং শুনতে হয় উল্টো কথা। এই অনাচার, এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শিশু-কিশোরদের এই জাগরণ আমাদের নতুন করে অভয়বাণী শোনায়, আশাবাদী করে। ইতিহাসে এই আন্দোলন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

স্ত্রীকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে কত কাল এ দেশে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়কের আন্দোলন’ করছেন, কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। প্রতিবছর বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ নাকি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, প্রতিদিনের হিসাবে তা প্রায় অর্ধশত! অথচ এই রাষ্ট্রের যাঁরা মালিক মোক্তার, তাদের অন্তরে সামান্য আঁচড় পড়ে না! এ এক আশ্চর্য দেশ, এখানে মন্ত্রীরা, ক্ষমতাবানেরা উল্টোপথে গাড়ি হাকান; মন্ত্রী-পুলিশের গাড়ির চালকের লাইসেন্স লাগে না, থাকে না! এখানে মৃত্যুপথযাত্রীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকে, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না হৃদয়হীন চালকদের জমাট বাঁধানো রাস্তায়।

শিশু, কিশোর-কিশোরীরা এখন রাজপথে এই বেপথু রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঠিক রাস্তায় তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঘুণ বাসা বেঁধেছে, তাকে এখনই উপড়ে ফেলতে না পারলে তা আরও ভয়াবহ হবে, সমগ্র জাতিকেই গ্রাস করে ফেলবে, পঙ্গু করে ফেলবে একদিন। তাই এই যুগসন্তানদের দেখানো পথে, সময় এসেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করার। সময় এসেছে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ উপলব্ধি করার আর আমাদের অনুভূতির বদ্ধ অর্গল খুলে দিয়েছে যে নিষ্পাপ, নিরপরাধ আগামী প্রজন্মকে সত্যিকারের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার।

আমরা জানি, এই কোমলমতি শিশুরা ক্লাসে ফিরে যাবে, আগামী জীবনের অনাগত জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে যত দ্রুত তারা ক্লাসে ফিরে যাবে, ততই মঙ্গল। কিন্তু কী হবে তাদের নিরাপদ জীবনের দাবি? সরকার স্বীকার করছে তাদের সব দাবিই ন্যায্য এবং সরকার তাদের ‘দাবি মেনেও নিয়েছে’। এ কথা ঠিক, নয় দফা দাবি বাস্তবায়ন করতে সময় প্রয়োজন। রাতারাতি সব বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তেমন কথা কেউ বলবে না, বলছে না। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘেই ভয় পায়। তাই তারা আশ্বস্ত হতে চায়, সরকার তেমন বাস্তব কিছু করে দেখাক যে তাদের নয় দফা দাবি সত্যিকার অর্থেই মেনে নিয়েছে সরকার। অন্তত একজন মন্ত্রী গদি থেকে চলে যাক।

গত কয়েক দিনে শান্তিপূর্ণ, স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু মানুষ। আমাদের শিশুরা যখন রাজপথে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে, তখনো রাস্তায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মানুষের জীবন ঝরে চলেছে। কোনো কোনো পক্ষ আবার হুমকি দিচ্ছে, কেউ বা দিচ্ছে উসকানিও। সন্দেহ জাগে, কোনো কোনো মহল হয়তো এই আন্দোলনকে পুঁজি করতে চায়। কারও কারও সন্দেহ, আন্দোলনকারীদের ওপর না নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে! সন্দেহ প্রবল হচ্ছে, পর্দার অন্তরালে হয়তো ভিন্ন খেলা চলতে পারে। পরিবহন সেক্টর কয়েক দশক ধরে যাঁদের হাতে জিম্মি, তাঁরা কোনো নতুন খেলায় মত্ত হতে পারে। তার আলামত দেখা যাচ্ছে, নাগরিকদের মনে তাই শঙ্কাও বাড়ছে।

আমাদের আশা, সব পক্ষেরই শুভবুদ্ধি জাগ্রত হবে এবং একটি বেদনাদায়ক, মর্মস্পর্শী ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি মহৎ আন্দোলন যেন কোনো ক্রমেই ব্যর্থতার চোরাবালিতে হারিয়ে না যায়।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
amirulkhan7@gmail. com