বিতর্কিত ভোটে গণতন্ত্রেরই হার হলো

এমারসন এমনানগাওয়া
এমারসন এমনানগাওয়া

জিম্বাবুয়ের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নতুন করে প্রমাণ করল, আধুনিক বিশ্বে সে দেশে গণতন্ত্রের এক কানাকড়িরও দাম নেই। এমারসন এমনানগাওয়ার দল জানু-পিএফ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী এমনানগাওয়াই প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।

উপনিবেশ-উত্তর যুগে এসে প্রথমবারের মতো জিম্বাবুয়ের সামনে গণতন্ত্র চর্চার একটি দারুণ সুযোগ এসেছিল। রবার্ট মুগাবে টানা ৩৭ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন এবং আমৃত্যু গদিতে থাকতে চেয়েছিলেন। গত বছর যখন সামরিক অভ্যুত্থানে মুগাবে সরে দাঁড়ান, তখন তাঁর বয়স ৯৩ বছর। তাঁর ক্ষমতা ছাড়ার আগে বেশ কয়েকবার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, তিনি এমনানগাওয়াকে উত্তরসূরি করতে যাচ্ছেন। আবার শোনা গিয়েছিল, রবার্ট মুগাবের স্ত্রী গ্রেস মুগাবে প্রধানমন্ত্রী হবেন। তবে সব বাধা সরিয়ে এমনানগাওয়া দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন।

এমনানগাওয়া দীর্ঘদিন রবার্ট মুগাবের ডান হাত ছিলেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সেই সুবাদে অজস্র সহিংস ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদেই তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী হতে পারছেন।

পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মুগাবের চেয়ে এমনানগাওয়া আরও খারাপ ও উৎপীড়ক শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছেন। তাঁর সরকারের সময় মুগাবের আমলের চেয়ে অনেক বেশি দুর্নীতি হবে বলেও মনে করেন তাঁরা। এমনানগাওয়া আসলে মুগাবেরই ঐতিহ্য জারি রাখবেন। সেখানে যেমন-তেমন একটি নির্বাচন দেওয়া হবে। কিছু লোক ভোটও দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার পেশিশক্তি বেশি এবং কে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হতে পারবেন, তার ওপর ভোটের ফল নির্ভর করবে।

নির্বাচন নিয়ে হাজারো অভিযোগ থাকলেও এমনানগাওয়া বলছেন, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। জনগণ তাঁর ওপর দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তিনি সে দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিভক্ত দেশবাসীকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে চান। তবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নেলসন চামিসা বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, এই নির্বাচনে ভোটের বালাই ছিল না। আগে থেকেই এমনানগাওয়ার লোকজন ভোট বাক্স ছিনতাই করে সিল মেরেছেন। এ কারণে তিনি সরকারকে সমর্থন দেবেন না।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কোথাও কোথাও ভোট গণনার আগেই ফল ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। আগে থেকেই জনমনে দৃঢ় ধারণা ছিল স্বচ্ছ নির্বাচন হলে চামিসা জয়লাভ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফল একেবারে উল্টে গেছে। চামিসা বলছেন, ফল চুরি হয়ে গেছে।

ফলাফলে দেখা গেছে, এমনানগাওয়া পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট ও চামিসা পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আসলে এমনানগাওয়ার জিতে যাওয়া নিয়ে যাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহ করতে না পারে, সে জন্য ভোটের ব্যবধান কমিয়ে দেখানো হয়েছে। জিম্বাবুয়ের নির্বাচনের ধরনটিকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদ’ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও তুরস্কে একই ধরনের নির্বাচন হয়েছে। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে পার্থক্য হলো এসব দেশে জিম্বাবুয়ের মতো মারামারি, কাটাকাটি হয়নি।

তুরস্ক ও রাশিয়াকে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বলে সেখানকার নেতাদের বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা কে কী বললেন, তা নিয়ে মাথা ঘামান না। সবাই আশা করেছিলেন, মুগাবে-পরবর্তী জিম্বাবুয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু এমনানগাওয়া শেষ পর্যন্ত সেদিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। সেনাবাহিনীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ তিনি প্রথম থেকে ভালোভাবে ধরে রেখেছেন।

ফল ঘোষণার পর দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। সহিংসতার পর রাজধানী হারারেকে ভুতুড়ে শহরের মতো দেখাচ্ছিল। এখনো শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকা সেনারা জনগণকে আইন মেনে চলতে আদেশ দিচ্ছেন। বলা যায়, চামিসার হাতে এখন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার তাঁকে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

তবে নির্বাচন স্বচ্ছ না হলেও দেশটিতে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের যে সূচনা হয়েছে, সেটিও একধরনের সান্ত্বনার জায়গা। সেখানে পরিণত গণতন্ত্রের একটি পরিবেশ আনতে পারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় শক্তিগুলো যদি জিম্বাবুয়ের ওপর স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য চাপ তৈরি করে, তাহলে সেখানে দ্রুত কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি কঠোরভাবে ঘোষণা দেয় যে তাদের পর্যবেক্ষকদের দেখভালে এবং উপস্থিতিতে ভোট গণনা করতে হবে; এর ব্যত্যয় হলে কোনো সরকারকে তারা বৈধতা দেবে না, তাহলে হয়তো কম সময়ের মধ্যে জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র চর্চা করা সম্ভব হতো।

ব্লুমবার্গ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

লিওনিদ বার্শিদস্কি বার্লিন ভিত্তিক রুশ সাংবাদিক