কত দিন টিকতে পারবেন ইমরান খান?

ইমরান খান
ইমরান খান

নির্বাচনে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই) নিজেদের বিজয়ী দাবি করার পর গত সোমবার ঘোষণা করেছে, তারা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পূরণ করতে সক্ষম একটি জোট গঠন করতে পেরেছে। অবশ্য নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি এবং পিটিআই নেতৃত্বাধীন ভবিষ্যৎ জোট সরকারের বৈধতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে।

নির্বাচনের আগে থেকেই অভিযোগ রয়েছে, সামরিক শক্তি ইমরানকে জেতানোর জন্য যা যা দরকার, তার সবই করে এসেছে। নির্বাচনের অল্প কয়েক দিন আগেই পিএমএল-এনের বেশ কয়েকজন নেতাকে দুর্নীতির মামলায় আটক করা, নওয়াজ শরিফ ও তাঁর মেয়ে মরিয়মকে কারাদণ্ড দেওয়া, আরেক পিএমএল-এন নেতা হানিফ আব্বাসিকে মাদক পাচারের মামলায় যাবজ্জীবন দেওয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম করতে করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। নির্বাচনের দিন অসংখ্য ভোটকেন্দ্র থেকে ইমরানের দল বাদে কমপক্ষে ছয়টি দলের পোলিং এজেন্টদের ভোট গণনার সময় বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফল ঘোষণায়ও ব্যাপক অনিয়ম ছিল। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে তেমন একটা গা করতে দেখা যায়নি।

২ আগস্ট পাকিস্তানের বড় দলগুলো ঘোষণা করেছে, তারা সবাই মিলে একটি ‘মহাজোট’ গঠন করে পার্লামেন্টের ভেতরে এবং বাইরে ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। দলগুলো হলো: ভুট্টো পরিবারের পিপিপি, নওয়াজের পিএমএল-এন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোট এমএমএ, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি, পাখতুনখাওয়া মিল্লি আওয়ামী পার্টি, ন্যাশনাল পার্টি বেলুচিস্তান ও কওমি ওয়াতান পার্টি।

তবে তাদের বাধা ডিঙিয়ে ইমরান খান ‘ফিনিশ লাইন’ ছুঁতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় আসন তিনি জোগাড় করতে পেরেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শিগগির তিনি একটি জোট সরকার গঠন করতে পারেন। তবে তিনি যে প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় আসন জোগাড় করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, সামরিক শক্তি ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং টাকাপয়সা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ইমরান খানের সঙ্গে জোট বাঁধতে বাধ্য করেছে। যাহোক, এখন মনে হচ্ছে ড্রাইভিং সিটে ইমরানই বসতে যাচ্ছেন; যদিও সামনের পথ এবড়োখেবড়ো এবং অনিশ্চিত। জোট সরকার গঠন করতে গেলে প্রথমেই ইমরানকে এমন কিছু লোকের ওপর নির্ভর করতে হবে, যাঁরা সব সময়ই তাঁর বিরোধিতা করে এসেছেন। করাচিভিত্তিক এমকিউএম ইমরানের সরকারে থাকবে। কিন্তু ইমরানের সঙ্গে ইতিমধ্যে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। পিএমএল-কিউ আরেকটি দল, যাদের সঙ্গে ইমরানের পুরোনো শত্রুতা আছে। পিএমএল-কিউ দলের সদস্যদের ইমরান এর আগে ‘খুনি’ এবং ‘পাঞ্জাবের সবচেয়ে বড় ডাকাত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেই দলটিও ইমরানের জোটে থাকছে।

ইমরান খানকে এখন ক্ষমতায় যেতে এমন সব লোকজনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হচ্ছে, যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা পাকিস্তানিদের কাছে খুবই কম। তাঁদের অনেককেই পাকিস্তানের বেশির ভাগ লোক ঘৃণা করে। এখন তাঁকে এমন সব লোকের সাহায্য চাইতে হয়েছে, যাঁদের একসময় তিনি অপমান করেছেন, গালিগালাজ করেছেন। এ ধরনের শরিকদের নিয়ে গঠন করা ইমরানের জোট সরকার ঝানু ঝানু রাজনীতিকদের প্রচণ্ড শক্তিশালী বিরোধী জোটকে মোকাবিলা করে কতক্ষণ টিকে থাকবে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। তবে ইমরানের টিকে থাকা না-থাকা নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর ওপর। তাঁকে ক্ষমতায় আনতে যেমন সেনাশক্তি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, তাঁর ক্ষমতায় থাকার পথের প্রধান বাধাও হবে তারা। অনেকে আশা করেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইমরান আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর কবজা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে স্বাধীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

হ্যাঁ, সেটা তিনি করতেই পারেন। তবে সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে তিনি যখনই বের হওয়ার চেষ্টা করবেন, তখন তাঁকে চরম বৈরী পরিবেশের মুখে পড়তে হবে। ইমরান যদি সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পা বাড়ান, তখন তাঁকে ফেলে দেওয়া সেনাবাহিনীর জন্য কোনো ব্যাপারই হবে না। তারা এমকিউএম এবং পিএমএল-কিউ—এই দুটো দলকে ইশারা করলেই তারা ইমরানের ওপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নেবে এবং জোট সরকার কাত হয়ে পড়ে যাবে। অথবা অসততা এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

পাঁচ বছর ধরে ইমরান সেনাপন্থী তৎপরতা চালিয়ে এসেছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করায় নওয়াজ শরিফকে আক্রমণ করেছেন। ইমরান কত দূর যেতে পারবেন, তা সময়ই বলবে। জয়ের পর দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিনি সম্পর্কোন্নয়ন করবেন। সত্যি সত্যি সেটা করতে গেলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সংঘাত বাধবে। সেনাবাহিনী তখন তাঁর ওপর খড়্গহস্ত হলে তাঁর জন্য এখন যে রাজনীতিকদের হেনস্তা হতে হচ্ছে, তাঁরা কেউ তখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবেন না।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

গুল বুখারি : লাহোরভিত্তিক সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী