ট্র্যাজেডি আসামে, রাজনৈতিক তাপ কলকাতায়

ভাষা ও ধর্মের কারণে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনে (এনআরসি) ৪০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহারা করার প্রতিবাদে কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ।
ভাষা ও ধর্মের কারণে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনে (এনআরসি) ৪০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহারা করার প্রতিবাদে কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ।

রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তায় ভারতের বৃহত্তর আরএসএস পরিবার দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য। আসামে বিজেপি সরকার যখন দুই সপ্তাহ আগে ৪০ লাখ বাংলাভাষীকে নাগরিকত্বহারা (অভারতীয়) ঘোষণা করল, ঠিক এর পাঁচ দিন আগে থেকে সম্ভাব্য বাঙালি শরণার্থীদের জন্য চাঁদা তোলা শুরু করল মিলআপ নামের এক হিন্দুত্ববাদী দাতব্য সংস্থা।

মিলআপ মূলত রক্ষণশীল ‘হিন্দু সংহতি’র একটি খণ্ডাংশ। নিজেদের যারা দাবি করে ভারতের সবচেয়ে বড় ‘ফান্ড রেইজিং’ সংস্থা হিসেবে। আট বছর হলো তাদের প্রতিষ্ঠার। এ পর্যন্ত তারা নানান উপলক্ষে ৩৩০ কোটি রুপি তুলেছে।

আসামের ‘হিন্দু বাঙালি’দের জন্য মিলআপ আপাতত ২৫ লাখ রুপি তুলতে চায়। অর্থের হিসাবের চেয়ে এ ক্ষেত্রে যেটা দেখার বিষয়—আসামে বাঙালিদের ওপর মরণ আঘাত হেনে পশ্চিমবঙ্গে একই রাজনৈতিক শক্তি সেই বেদনাকে ব্যবহার করছে অর্থ উত্তোলনে। তবে উত্তোলিত অর্থ আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) থেকে বাদ পড়া মুসলমানদের জন্য খরচ করতে নারাজ মিলআপ। বিষয়টি করুণ।

আসামের অভ্যন্তরীণ চিত্র এ মুহূর্তে আরও করুণ। এনআরসির মাধ্যমে তিন কোটি মানুষের আসাম ভূখণ্ডে প্রায় আট ভাগের এক ভাগ (৪০ লাখ ৭০৭ জন) নাগরিকত্ব হারালেও সেখানে পরিস্থিতি বিস্ময়করভাবে ‘শান্ত’ই বলা যায়। শঙ্কা ছিল, কিন্তু সহিংসতা কিছু হয়নি। আসাম গণপরিষদ (আসু) মিষ্টি বিতরণ করে এনআরসি থেকে বাংলাভাষীদের বাদ পড়া উদ্‌যাপন করেছে। আপাতত মনে হচ্ছে, এই ‘উদ্‌যাপন’ই সত্যি। ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘অবাঞ্ছিত’দের পক্ষে তেমন শক্ত ভূমিকায় নেই মূলধারার কোনো রাজনৈতিক শক্তি। তবে আসু ১৯৭৯ সাল থেকে মূলত মুসলমানদের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে আন্দোলন শুরু করলেও ২০১৮ সালে তার সমাপ্তি পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী নমশূদ্রও রাষ্ট্রপরিচয় হারাল। ফলে এনআরসি নিয়ে সমালোচনার ঢেউ এসে এ মুহূর্তে আঘাত হেনেছে পশ্চিমবঙ্গে। আরও স্পষ্ট করে বললে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি এখন রাজনীতির প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

সমগ্র ভারতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সবচেয়ে জোর গলায় আসামে বিজেপির এনআরসি কার্যক্রমের বিরোধিতা করছেন। মমতা এও বলেছেন, ‘এনআরসি বাংলাদেশের জন্য অপমানকর।’ স্পষ্টত মমতা বাংলাভাষীদের আবেগ ধারণ করতে ইচ্ছুক।

এনআরসির প্রতিবাদে কলকাতায় সংখ্যালঘু সংগঠনের কর্মীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
এনআরসির প্রতিবাদে কলকাতায় সংখ্যালঘু সংগঠনের কর্মীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

দুই.
গত ৩০ জুলাই এনআরসি ঘোষণার পর একজন মন্ত্রীসহ তৃণমূলের আট নেতা তাৎক্ষণিকভাবে আসাম রওনা দিয়েছিলেন পরিস্থিতি দেখতে। তাঁদের শিলচর বিমানবন্দরে হেনস্তা করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে আসামের প্রশাসন। পুরো রাত বিমানবন্দরেই বসিয়ে রাখা হয় তাঁদের। টয়লেটেও পাহারা ছাড়া যেতে পারেননি তাঁরা। গুয়াহাটি আর যাওয়া হয়নি তাই। এর প্রতিবাদে পুরো পশ্চিমবঙ্গে দুদিন কালো দিবসও পালিত হলো।

তৃণমূল বলছে, বিজেপির এনআরসি আসলে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধমাত্র। বিজেপি বলছে, সবকিছু ঘটেছে ১৯৮৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী। যে চুক্তিতে ১৯৭১-এর মার্চকে আসামে নাগরিকত্বের একটি মাইলফলক তারিখ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। বলা হচ্ছে, যারা ওই সময়ের আগে আসামে বসবাসের ‘প্রমাণ’ দেখাতে পেরেছে, তারাই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেল। বাকিদের ‘বিদেশি’ হিসেবে চলে যেতে হবে।

তবে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ত্রুটি ধরা পড়ছে ক্রমাগত। লাখ লাখ পরিবারকে প্রশাসনিক ভুলে অভারতীয় ঘোষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে আছে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আমেদের পরিবার থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে কাজ করা মানুষও। এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা দলের একজন অফিসারও নিবন্ধন তালিকায় নিজের নাম খুঁজে পাননি।

এসব ‘ত্রুটি’র কিছু সংশোধন প্রক্রিয়া চলছে এ মুহূর্তে। কিন্তু তাতে নাগরিকত্বহারা মানুষের বিশাল সংখ্যার সামান্যই হেরফের হবে বলে মনে হয়। কারণ, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসন পুরো ঘটনাকে মানবিক বিপর্যয় নয়, রাজনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছে।

তিন.
৪০ লাখ মানুষকে প্রশাসনিক এক ঘোষণায় নাগরিকত্বহারা করা বিশ্বে এক বিরল নজির। এই কাজে ভারতে উচ্চ আদালতের চাপও ছিল। এনআরসি করে বিজেপি আসামে অসমিয়া বর্ণহিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষা করতে পারল বলে মনে করছে। কারণ, নাগরিকত্বহারাদের মধ্যে মুসলমানদের পাশাপাশি যেসব হিন্দু রয়েছে, তাদের ৮০ শতাংশই নিম্নবর্ণের নমশূদ্র। দীর্ঘদিন ধরে অসমিয়া হিন্দুদের ভয় ছিল মুসলমানরা চা-বাগানের সাবেক শ্রমিক, নেপালি এবং ছোট খাটো জনজাতির সঙ্গে মিলে অসমিয়া হিন্দুদের ভোটে কোণঠাসা করে ফেলবে। সেই শঙ্কাকেই বিজেপি পুঁজি করেছে—কংগ্রেস যা করতে বহু বছর ইতস্তত করছিল।

যেহেতু ৪০ লাখ মুসলমান ও নমশূদ্র আর ভোটার তালিকায় নেই, তাই আগামী নির্বাচনে আসামে অসমিয়ারাই ভোটের হিসেবে এগিয়ে থাকবে। অসমিয়ারা এই এনআরসির সমর্থক। বিজেপির পাশাপাশি কংগ্রেসও তাই এ মুহূর্তে অসমিয়াদের সুরে সুর মিলিয়ে এনআরসির গুণগান করছে। তারা এর কর্তৃত্বও দাবি করছে। বলতে চাইছে, অতীতে তারাই এই প্রক্রিয়া শুরু করে। ‘বিদেশি’ তাড়াতে ১৯৮৫ সালে ‘আসু’র সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন রাজীব গান্ধী।

বিজেপি বলছে, রাজীব গান্ধী চুক্তি করলেও ‘অবাঞ্ছিত’দের চিহ্নিত করার পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের ‘হিম্মত’ কেবল তারাই দেখাতে পারল। বিজেপি ইঙ্গিত দিচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গেও তারা একই হিম্মত দেখাতে ইচ্ছুক। স্থানীয় বিজেপি প্রেসিডেন্ট দিলীপ ঘোষ জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে ক্ষমতায় গেলে তারা আসামের মতোই এখানেও ‘বিদেশি’দের খুঁজে বের করবে।

অন্যদিকে, আসামে কংগ্রেস এনআরসির পক্ষে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে বিপক্ষে। বিধানসভায় কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, তাঁরা এই রাজ্যে এনআরসির উদ্যোগ মানবেন না। তিনি একে বলছেন ‘আগুন নিয়ে খেলা।’ সিপিএম বলছে, তারাও এতে রাজি নয়।

এনআরসি এভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ ঘটিয়েছে। যার একদিকে কেবল বিজেপি, বাকিরা সব অন্যদিকে। এরূপ মেরুকরণে বিজেপিই লাভবান। জোরেশোরে তারা অন্য সব দলকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’দের আশ্রয়দাতা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে।

চার.
আসামে ৪০ লাখ মানুষকে রাষ্ট্রবিহীন করতে পারাকে বিজেপি ভারতের অন্যত্রও সফলতা হিসেবে তুলে ধরছে। তারা মনে করছে, এতে রাজ্যটিতে মুসলমান সংসদ সদস্য কমানো যাবে। ভারতের অন্যত্রও মুসলমানভীতি বিজেপির অন্যতম রাজনৈতিক পণ্য। তারা বলছে, ১৯৫২ সালে আসামের বিধানসভায় মুসলমান বিধায়ক ছিলেন ১২ জন। চার দশক পর দেখা গেছে, সেটা ২৪। রাজ্যটিতে লোকসংখ্যাও ৩০ শতাংশ হয়ে গেছে মুসলমান। এ সবকিছুই ঘটেছে ‘বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানদের কারণে’। এনআরসি এটা ঠেকাতে পারল। এই প্রশাসনিক ‘সফলতা’য় তারা এখন পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি করতে চায় নতুন করে।

আসামের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হলে মুসলমানদের মতোই নিম্নবর্গের অনেক হিন্দু নাগরিকত্ব হারাবেন বলে শঙ্কা অনেকের। বিজেপি সেটা থেকেও রাজনৈতিক ফায়দা নিতে তৎপর আছে। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকত্বহারা সম্ভাব্য বাঙালি হিন্দুদের তারা নতুন রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্ব আইনে (২০১৬ সালের সংশোধন অনুযায়ী) নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে। বাদ যাবে কেবল মুসলমানরা। এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের বিজেপি দেখতে চায় ‘শরণার্থী’রূপে, আর মুসলমানদের দেখাতে চায় ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে।

কিন্তু ‘শরণার্থী হিন্দু’দের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নে আসাম গণপরিষদের আপত্তি আছে। আসু আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটের সদস্য। আসু এনআরসি থেকে বাদ পড়া কাউকে রাজ্যে রাখতে অনিচ্ছুক। এতে ভোটের হিসাবে সে এগিয়ে থাকে। এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিয়ে বিজেপিও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে ইচ্ছুক। এভাবেই নাগরিকত্বহারা মানুষগুলো এখন ভোটের সমীকরণের বলি হয়ে উঠেছে।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালের নির্বাচনে এনআরসি বিজেপির মূল রণনৈতিক হাতিয়ার। এই ইস্যুতে বিজেপিকে মোকাবিলা না করে উপায় নেই তৃণমূলের। পশ্চিমবঙ্গে মমতার শক্তি-ভিত দাঁড়িয়ে আছে নমশূদ্র ও মুসলমানদের সমর্থনের ওপর। আসামের করুণ অভিজ্ঞতা এই দুই জনগোষ্ঠীকে মমতার আরও নিকটে নেবে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বর্ণহিন্দুদের ভোট আশা করতে পারে বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো শক্তি কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের জন্য স্থানীয় রাজনীতিতে আপাতত পৃথক কোনো ইস্যু রইল না।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক