'ওরা আমাকে ধ্বংস করবে, পরে তোমাকে'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ইয়াহিয়া: আপনি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসনেও জয়ী হতে পারেননি। সেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। ভুট্টোর সঙ্গে আপনি কথা বলুন এবং আমাকে তার ফল জানান। 

মুজিব: এটি হলো গণতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমিই সরকার গঠন করব।

ইয়াহিয়া: আপনাকে স্বাগত। কিন্তু আপনার নিজেকে সমগ্র পাকিস্তানের নেতা হিসেবে ভাবতে হবে। 
মুজিব: হ্যাঁ, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আসছেন এবং কথা বলছেন।

ইয়াহিয়া: কিন্তু ভুট্টো আসেননি। 
মুজিব: না, ভুট্টো আসেননি। অন্যান্য দলের নেতারা এসেছেন এবং কথাও বলে গেছেন।

ইয়াহিয়া: তাঁরা পরাজিত দলের নেতা। সব ফেডারেল ইউনিটের নেতারা একত্র হলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে। 
মুজিব: যে কেউ আলোচনা করতে চাইলে আমার কাছে আসতে পারেন।

পাকিস্তানি আমলা-লেখক হাসান জহির তাঁর সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান বইয়ে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের কথোপকথন এভাবেই তুলে ধরেছেন।

১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহের প্রধান কুশীলব ছিলেন তিনজন। নির্বাচনে বিজয়ী নেতা আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান।

ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন, নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না এবং সেই সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর অবস্থান অনেক সুদৃঢ় করতে পারবেন। পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লিগসহ কয়েকটি ডানপন্থী দলকে গোয়েন্দা সংস্থা মোটা অঙ্কের টাকাও দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল হলো শাসকগোষ্ঠীর ধারণার বিপরীত। শেখ মুজিব সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেন। গণতন্ত্র মানলে তাঁর হাতে ক্ষমতা দিতে হয়।

শেখ মুজিব তাঁর ঘনিষ্ঠজনকে বলেছেন, ‘আমার উদ্দেশ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব। একবার নির্বাচন হয়ে গেলে কে আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে।’

নির্বাচনের ফল ভুট্টোকেও হতাশ করে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে খেপিয়ে তুলতে উগ্র কথাবার্তা বলেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘোঁট পাকাতে থাকেন। তবে আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল। দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডিতে লিখেছেন, ‘আমি একাত্তরের জানুয়ারিতে যখন ঢাকা গেলাম, তখন আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পেরেছি। তাঁকে আমার মনে হলো অসম্ভব বিনয়ী। যে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, সেসব নিয়ে তিনি যুক্তিসহকারে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলেন।’ অন্যত্র বলেছেন, বাঙালি ভাইদের প্রতি আমার দরদ আছে কিন্তু মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশ চান, এখানকার মানুষও পাঞ্জাব দেশ, সিন্ধু দেশ চাইবে-তাহলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে না।’

১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান আন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল সম্মেলন আহ্বান করেন। তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালি) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গাউস বক্স বিজেঞ্জো। সম্মেলন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা মনে করেন, একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির মধ্য দিয়ে সম্মেলন সফল হতে পারে। আইয়ুব প্রথমে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চাইলে মুজিব তা নাকচ করে দেন। ফলে সম্মেলন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরে আইয়ুব তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিলে তিনি বীরের বেশে লাহোরে এসে পৌঁছান।

তাঁর ভাষায়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফার পক্ষে প্রচার চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিটি প্রান্তে ঝড় তুলেছেন। বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশও (বর্তমান পাখতুনখাওয়া) কেন্দ্র দ্বারা বঞ্চিত এবং সেখানকার জনগণও স্বায়ত্তশাসন ও ন্যায্য অধিকার চায়। বেলুচিস্তান ইতিমধ্যে তিন দফা সেনা অভিযানের শিকার হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফল ছিল সেনাবাহিনীর জন্য আক্ষরিক অর্থে ‘বজ্রাঘাত’।

ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি শেখ মুজিব ও তাঁর দলের হাতে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের নির্দেশেই চলে প্রশাসন; সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শুধু সেনানিবাসগুলোর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। কয়েক দিন পর রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে বন্ধুরা বিজেঞ্জোকে ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। এরপর বিজেঞ্জো শেখ মুজিবকে টেলেক্স করেন: যদি তিনি মনে করেন আমার ঢাকা যাওয়া কোনো কাজে আসবে তাহলে তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। পরদিন মুজিবের জবাব আসে: তিনি ঢাকায় এলে খুব খুশি হবেন এবং সেখানে তাঁর অতিথি হয়ে থাকবেন। এরপর ১১ মার্চ বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খান ঢাকায় এসে পৌঁছান।

পরদিন ১৪ মার্চ ওয়ালি খান ও বিজেঞ্জো শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এরপর বিজেঞ্জো মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার পরিকল্পনা খোলাখুলি আমাদের জানাবেন আশা করি। আমরা মনে করি, যেহেতু আপনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, আপনার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। কিন্তু আপনি একতরফা স্বাধীনতা (ইউডিআই) ঘোষণা করলে আমরা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়ব।’

বিজেঞ্জো জানান, ‘এরপর আমরা মূল কথায় আসি। বললাম, পরিস্থিতি খুবই কঠিন। আপনি যদি অনমনীয় থাকেন, পাকিস্তান ভাঙবেই। আমরা এও মনে করি যে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করা উচিত এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় বের করা উচিত। এটি আপনার ও আপনার দলের আইনগত অধিকার। এই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যোগ্যতা এঁদের (ইয়াহিয়া প্রমুখ) নেই।’ মুজিব বললেন, ‘আমি আপনাদের বলছি, যদি পাকিস্তান ভেঙেও যায় তারা (ইয়াহিয়া গং) আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।’

সে সময় অসহযোগ আন্দোলনের চিত্র দেখে ওয়ালি খান বলেছিলেন, আজ গান্ধী বেঁচে থাকলে লজ্জা পেতেন। কেননা, এটা ছিল সর্বাত্মক অসহযোগ। এরপর ওয়ালি খান ও বিজেঞ্জো ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করলে তিনি অনড় মনোভাব দেখান। ইতিমধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো দলবল নিয়ে ঢাকায় পৌঁছালে সেটিকে এই দুই নেতা অন্তর্ঘাত হিসেবে দেখেন। কেননা, ভুট্টো চান না ইয়াহিয়া শেখ সাহেবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক।

বিজেঞ্জো ও ওয়ালি খান ফের শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘এখন আর আমি দুই কমিটির বৈঠকের কথা বলব না; অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাই। আমার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তারপর ওই দুই নেতা দ্বিতীয় দফা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবের প্রস্তাবের কথা বললেন। তিনি জবাব দেন, ‘যদি আপনার বন্ধু মুজিব কথা না শোনেন, আমার সেনাবাহিনী জানে কী করতে হবে।’

তৃতীয়বার তাঁরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি (মুজিব) তাঁদের বিপদের কথা জানান, ‘এখন আপনাদের ঢাকা ত্যাগ করাই শ্রেয়। সেনাবাহিনী আগামী দু-এক দিনের মধ্যে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে আপনাদের উপস্থিতি আর কোনো কাজে আসবে না। (সূত্র: সার্চ অব সলিউশন, আজ অটোবায়োগ্রাফি অব মির গাউস বক্স বিজেঞ্জো, পাকিস্তান স্টাডি সেন্টার: করাচি ইউনিভার্সিটি)

২১ মার্চ বিকেলে জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। ইয়াহিয়া তাঁকে মুজিবের সঙ্গে তাঁর বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করেন, যার মূল কথা ছিল-ঢাকা ও ইসলামাবাদে পৃথক সংসদীয় কমিটির বৈঠক আহ্বান এবং অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার। সংবিধান রচনা না হওয়া পর্যন্ত ইয়াহিয়া কেন্দ্রে শাসনকাজ চালাবেন। জবাবে ভুট্টো বললেন, পাকিস্তান ভাঙার এই প্রস্তাবের অংশ হওয়া তাঁর উচিত হবে না।

পরদিন বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে মুজিব জানতে চান, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে তিনি চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন কি না? প্রেসিডেন্ট বললেন, এতে ভুট্টোর সম্মতির প্রয়োজন আছে। মুজিবের উত্তর, তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের। ভুট্টো নীতিগতভাবে সম্মতি দিলে তিনি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসতে পারেন। তার আগে তাঁদের কথাবার্তা হবে অনানুষ্ঠানিক।

ভুট্টো মুজিবকে অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট অফিসের বাইরে চলে এলেন। তাঁরা পাশের কক্ষে এলে মুজিব সামরিক সচিবকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন, যাতে তাঁরা দুজন কথা বলতে পারেন। ভুট্টো বলেন, তিনি আমার হাত ধরে তাঁর পাশে বসতে বলেন এবং জানান, পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং উত্তরণে আমার সহায়তা চান। এই পর্যায়ে আমরা ভাবলাম, কক্ষে আড়ি পাতা হতে পারে। আমরা পেছনের বারান্দায় গেলাম এবং পাশাপাশি বসলাম। এরপর মুজিব বললেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টিই একমাত্র শক্তি। তিনি যা চান সে বিষয়ে তিনি যেন সহায়তা করেন, বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে তাঁর হাতে ছেড়ে দেবেন।

ভুট্টো দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি বইয়ে লিখেছেন, শেখ মুজিবের মতে এটাই উত্তরণের একমাত্র উপায়। তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘তাদের (সেনাবাহিনী) বিশ্বাস করো না। যদি তারা আমাকে প্রথম ধ্বংস করে, পরে তোমাকে ধ্বংস করবে। আমি উত্তর দিলাম, আমি ইতিহাসের কাছে ধ্বংস হওয়ার চেয়ে সেনাবাহিনীর হাতে ধ্বংস হতে রাজি আছি। মুজিব তাঁর প্রস্তাব গ্রহণের জন্য ভুট্টোকে চাপ দিতে লাগলেন।’ এরপর ইয়াহিয়া ভুট্টোকে তাঁদের আলোচনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ভুট্টো তাঁকে বলেন, ‘আমি দুই পাকিস্তান তত্ত্বের শরিক হতে চাই না।’ (সূত্র, জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, স্ট্যানলি উলপার্ট)। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সেনা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেন। আর ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়াউল হক প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ভুট্টোকে ফাঁসি দেন।

পাকিস্তান ইস্তেকলাল পার্টির নেতা ও সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এম আসগর খানও মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করতে। তিনি সংকট উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে মুজিব বলেন, ‘সামনের চিত্র বেশ পরিষ্কার। প্রথমে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন। এরপর ভুট্টো আসবেন। আলোচনা করবেন। এরপর সেনাবাহিনী অভিযান চালাবে।’ সেটি ছিল তাঁর অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]