কিশোর-তরুণ বিক্ষোভের মর্মকথা

ঘাতক বাসের চাপায় দুই সহপাঠীর করুণ মৃত্যুর প্রতিবাদে রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে রাস্তায় নেমে এসেছিল ২৯ জুলাই। তারপর যেন অবিরত মিছিল শুরু হলো। নেতাবিহীন, পূর্বপরিকল্পনাহীন এত কচি-কাঁচা মুখের মিছিল এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। এই কিশোর-তরুণ বিক্ষোভ শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল ঘটনা। কিন্তু কী এই বিক্ষোভের মর্মকথা?

সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে গড়ে ওঠা কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের প্রাথমিক নয় দফা দাবিকে ছাপিয়ে পরিবহন খাতের দুর্বৃত্তায়িত কাঠামো বদলানোতেই নিবিষ্ট হয়ে পড়েছে। বস্তুত তারা পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে যেন চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। তাদের সর্বাধিক উচ্চারিত স্লোগান ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো একটি আন্দোলনে ব্যবহৃত হলো। স্পষ্ট করেই ফেস্টুনে লিখে নিয়ে এসেছে, ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’।

তরুণেরা তাদের দুই সহপাঠী হত্যার বিচার চেয়ে পথে নেমেছে, কিন্তু পথে নেমে দেখিয়েছে কীভাবে ব্যবস্থা সচল রাখতে হয়। লেন ধরে গাড়ি চলা, ইমার্জেন্সি লেন জরুরি সেবার জন্য ফাঁকা রাখা-সড়ক ব্যবস্থাপনার এ বিষয়গুলো আমাদের স্মৃতি থেকেই মুছে গিয়েছিল। তারা পথে নেমেছিল বলেই আমরা জানতে পেরেছি, সাধারণের তো বটেই, আমাদের আইন প্রয়োগকারী থেকে শুরু করে আইন প্রণয়নকারীদের অনেকেরই ড্রাইভিং ‘লাইসেন্স নেই’! তারা লাইসেন্সবিহীন ক্ষমতাধরদের গাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে, উল্টো পথে চলা ক্ষমতাবানের গাড়ি ঘুরিয়ে ঠিক পথে এনে দিয়েছে। বলেছে, আইন সবার জন্য সমান। আইন ও সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় তাদের এই অভিনব সরল দৃঢ়তার জন্যই আজ বিআরটিএতে লাইসেন্স গ্রহণের হিড়িক পড়েছে-যে তাগিদ আমাদের রাষ্ট্র জেল-জরিমানা, বলপ্রয়োগ করেও মানুষের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি।

তারা নেমে এসেছিল হাজারে হাজারে। এত বিশাল জমায়েত, অথচ কী আশ্চর্য রকমের নৈরাজ্যবিমুখ! আন্দোলনের সাধারণ প্রবণতা থাকে আইন অমান্য করার। অথচ এই আন্দোলনে আমরা দেখলাম, তারা আইন মান্য করা শেখাচ্ছে। জাতি হিসেবে আমাদের সব বেআইনি কর্মকাণ্ড ও নৈরাজ্য অবসানে তরুণতর এই প্রজন্ম দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিল। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় ভরসার কথা খুব বেশি আর নেই।

নৈতিকভাবে তারা এতটাই সবল ও সঠিক ছিল যে তাদের আন্দোলনের বিপক্ষে বলার মতো কোনো সুযোগ ক্ষমতাসীন মহলেরও ছিল না। বরং তাদের দাবির ন্যায্যতা স্বীকার করে নিয়ে, তাদের রাজপথে জনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রশংসা করে এগুলো তাদের কাজ নয় বলে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের আশ্বাসে ভরসা না রেখে তারা যে বারবার পথে নেমে এসেছিল, তার ব্যাখ্যা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে করতে গেলে তারুণ্যের এই জাগরণকে অসম্মান করা হয় এবং নিজেদেরও যথেষ্ট ফাঁকি দেওয়া হয়। কিন্তু চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না।

মন্ত্রী-নেতাদের আশ্বাসে কিশোরেরা যে ভরসা রাখতে পারেনি, তা সরকারের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সরকার ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে, যা সরকারকে সন্দিহান, ভীত ও দুর্বল করে। আর দুর্বল সরকার ভুল করে এবং ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সে সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকে, জনগণকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং সবখানে ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার তাগিদে সে তখন অসহিষ্ণু ও নিপীড়ক হয়ে ওঠে এবং দলবাজিতে লিপ্ত হয়। কিন্তু কোনো নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থাই চিরকাল টিকতে পারে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের তরুণেরা বিচারের দাবি করছে, কারণ আমাদের দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে, কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে এবং নাগরিকের স্বার্থহানি ঘটাচ্ছে। আর এই গড়ে ওঠার এবং ভেঙে পড়ার কারণ হলো আমাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও রাষ্ট্রকাঠামো। আর্থিক খাত থেকে শুরু করে পাথর-কয়লাখনিসহ আমাদের রাষ্ট্রের অনেক ক্ষেত্রই আজ দুর্বৃত্তায়নের কবলে। এই দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এবং দলীয়করণের আবরণে। আর এই রাষ্ট্রকাঠামোই কোটারি স্বার্থে ও নাগরিকের বিপক্ষে কাজ করে এবং ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। তবে আমাদের বর্তমান অবস্থা একদিনে ঘটেনি এবং এক সরকারও এর জন্য দায়ী নয়। এ অবস্থা বহুদিনের অপশাসনেরই ফসল এবং সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ নিঃসন্দেহে এমন অপশাসন থেকে সৃষ্ট পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতা তার নিপীড়নমূলক আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া এই নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রকাঠামোরই পরিচায়ক। সাংবিধানিক অধিকার ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে অমান্য করে পুলিশি হেফাজতে তাঁকে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থার এমন অবনতি ঘটেছে যে উচ্চ আদালত তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন, আর সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন নিপীড়নমূলক আচরণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ না করে পারে না।

রাষ্ট্রযন্ত্রের নাগরিকের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি আমার বাসভবনে একদল দুষ্কৃতকারীর সাম্প্রতিক সশস্ত্র হামলা থেকে। ৪ আগস্ট আমরা আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় পারিবারিকভাবে বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সম্মানে একটি সৌজন্য নৈশভোজের আয়োজন করি, যার তারিখ নির্ধারিত হয় অনেক আগে গত ৯ জুলাই। আমন্ত্রিতদের তালিকাও ছাত্রবিক্ষোভ শুরুর আগেই মার্কিন দূতাবাসে জানিয়ে দেওয়া হয়। এই পারিবারিক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের বাইরে একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন আমাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ড. কামাল হোসেন ও হাফিজউদ্দিন খান দম্পতি। আমার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, দুই কন্যাসহ মোট দশজন নিয়ে ছিল এই নৈশভোজ।

নৈশভোজ শেষে রাত ১১টার দিকে রাষ্ট্রদূত বিদায় নিয়ে যখন গাড়িতে উঠছিলেন, একদল সশস্ত্র ব্যক্তি তাঁর গাড়িবহরের ওপর হামলা করে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত দুটি সরকারি গাড়ি। একই সঙ্গে হামলা হয় আমার বাসায়। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ‘৯৯৯’-তে কল করার পর হামলা শেষ হওয়ার পর পুলিশ আসে, যদিও তারা আমাদের সঙ্গে কথা না বলে চলে যায়।

নৈশভোজের বিষয়টি ছিল নিতান্তই একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং এর তারিখ কিশোর বিক্ষোভ শুরুর ২০ দিন আগে নির্ধারিত হলেও স্বার্থান্বেষী মহল এটিকে নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পুলিশের বরাত দিয়ে বিডিনিউজ ২৪. কম (৬ আগস্ট ২০১৮) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আমার বাসার নৈশভোজে ‘ড. কামাল হোসেন, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, এম হাফিজউদ্দিন খান, বিচারপতি আবদুর রউফসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত’ থাকার কথা বলা হয়। এটি একটি সর্বৈব অপপ্রচার, কারণ এই পূর্বনির্ধারিত পারিবারিক অনুষ্ঠানে ড. হোসেন ও খান দম্পতি ব্যতীত বাইরের অন্য কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং কেউ উপস্থিতও ছিলেন না।

পূর্বনির্ধারিত ও পারিবারিকভাবে আয়োজিত একটি নৈশভোজের বিষয়কে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার এই অপচেষ্টা আমাদের ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোরই নিদর্শন, যা নাগরিকের পরিবর্তে কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থই রক্ষা করে। আমাদের কিশোর-কিশোরীরা এই দেউলিয়াত্ব ও দুর্বৃত্তায়নের চক্র ভাঙার তাগিদেই রাস্তায় নেমেছিল। আমার মতে, এটিই তাদের বিক্ষোভের মর্মকথা। তাই আশা করি, ক্ষমতাসীনেরা ষড়যন্ত্রতন্ত্রের খোঁজে সময়ক্ষেপণ না করে কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে মেরামতের কাজে মনোনিবেশ করবে, তাহলেই তাদের পক্ষে জনগণের হৃদয়-মন জয় করা সম্ভব হবে এবং রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক