আশা এখন গরুতে

আশা জাগাচ্ছে দেশি গরু। না। এটা কোনো রসিকতা নয়। প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত ইফতেখার মাহমুদের প্রতিবেদন। দেশে গরুর নতুন নতুন খামার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন বছরে দেশে ১৫ হাজার নতুন খামার গড়ে উঠেছে। অনলাইন ও খামার থেকে অনেকে গরু বিক্রি শুরু করে দিয়েছেন। আশা করি, এবার কোরবানির ঈদে গরুর কোনো সংকট হবে না। দেশি গরু দিয়েই আমরা এবার দেশের চাহিদা মেটাতে পারব।’

এর আগে প্রথম আলোর অরণ্যে রোদন কলামে আমি এই কথা লিখেছিলাম (১০ এপ্রিল ২০১৫):
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিএসএফের জওয়ানদের বলেছেন, বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধ করতে হবে। তাঁর কাছে খবর আছে, ভারতের সীমান্তে কড়াকড়ি বাড়ানোয় বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গরু পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হলে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম আরও ৭০ শতাংশ বেড়ে যাবে। তখন ওখানকার মানুষ গরু খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর (২ এপ্রিল ২০১৫)।

কাজেই এটাকে বেখবর বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের পত্রিকা ডেইলি স্টার এই উক্তিটাকে দিনের উদ্ধৃতি হিসেবে ছেপেছেও। এরই প্রেক্ষাপটে আমার মন্তব্য ছিল:
বাংলাদেশ অলৌকিক সব উন্নতির নজির দেখিয়ে পৃথিবীকে নানা দিক থেকে অবাক করছে। ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ নামে সেসব প্রচলিত ও প্রশংসিত। এত চাহিদা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে তো রীতিমতো রুপালি বিপ্লব ঘটে গেছে। জ্যান্ত পাঙাশ মাছ লাফাচ্ছে, খাওয়ার লোক নেই। ডিম, দুধ, কলা থেকে শুরু করে বাউকুল-সর্বত্র বিপ্লব ঘটে গেছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর চার নম্বরে। বাংলাদেশের সৃজনশীল ও পরিশ্রমী মানুষ যদি একবার বোঝে গরু উৎপাদনটা লাভজনক, তাহলে আগামী চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গরু-বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা সেই বিপ্লবকে ‘শিং বিপ্লব’ নাম দিতে পারি। দেখবেন, আমাদের ঘরে ঘরে, উঠোনে, মাঠে-ঘাটে, খামারে গরু আর গরু, কত জাতের গরুই না চাষ করা হবে। তার ফলটা আমরা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হতে দেখব, ৩১ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে নগদে, তারপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রপ্তানি করব গরুর মাংস। শুধু কি মাংস, আমাদের খেতে-খামারে রাসায়নিক সার দরকার হবে না-গোবর বড় উৎকৃষ্ট সার-কৃষিতে উৎপাদন বাড়বে, পরিবেশ বাঁচবে, সার খাত থেকে বেঁচে যাবে বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের চামড়া উৎপাদন আর রপ্তানি বাড়বে, চামড়াশিল্পে উন্নতি ঘটবে। আমরা সস্তায় জুতা পরব আর গরুর লেজের রোম দিয়ে বুরুশ বানিয়ে সেই জুতা পালিশ করব!

মাত্র তিন বছরে আমার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাচ্ছে। শাবাশ বাংলাদেশ। শাবাশ বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের মেয়েরা পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে ১৪-০ গোলে। বাংলাদেশের কৃষকেরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার যে ঘনত্ব, সেই অনুযায়ী সাজানো হলে সারা পৃথিবীর মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকটায় এঁটে যাবে। বাকি অর্ধেক আমেরিকা পড়ে থাকবে ফাঁকা। আজকে আমেরিকার কৃষককে যদি বলা হয়, সারা পৃথিবীর মানুষকে খাওয়াতে হবে, সারা বছর, ডাবল ডাবল খাওয়া, পৃথিবীর আর কোথাও চাষ হবে না, তাহলে তাদের ওপরে যে চাপ পড়ত, সেই পরিমাণ চাপ বাংলাদেশের কৃষকেরা বহন করে চলেছেন এবং চলেছেন সার্থকতার সঙ্গে।

কাজেই আশা জাগাচ্ছে গরু, কথাটাকে তির্যক অর্থে দেখার কিছু নাই। যদিও আমাদের ছোটবেলায় স্যাররা খারাপ ছাত্রদের গরু বলেই ডাকতেন। দেশে গাধা নেই বলেই হয়তো গরুর কথাটা আসত, তা না হলে গাধা বলেই আমাদের ডাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল। সেই যে এক চাষা স্কুলে গাধাটাকে নিয়ে গিয়েছিল ভর্তি করাতে, কারণ সে মাস্টার মশাইকে বলতে শুনেছিল, কত গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম, আর তোকে মানুষ করতে পারব না।

গরু নিয়ে কোনো কৌতুক মনে পড়ছে না। শুধু ইশপের গল্পে এক ব্যাঙ গরু হতে চেয়ে পেট ফোলাতে ফোলাতে মরেই গিয়েছিল।

ছাগল বিষয়ে কৌতুকটা ফেসবুকে ব্যাপক প্রচলিত। সেটা একবার গদ্যকার্টুনে লিখেছিলাম। আবার কপি পেস্ট করলে কি আপনারা রাগ করবেন?
উপস্থাপক: আপনি আপনার ছাগলকে কী খাওয়ান?
ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?
উপস্থাপক: কালোটারে...
ছাগলচাষি: ঘাস।
উপস্থাপক: আর সাদাটারে?
ছাগলচাষি: ওইটারেও ঘাস খাওয়াই।
উপস্থাপক: ও আচ্ছা। আপনে ওইগুলানরে রাতে কই রাখেন?
ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?
উপস্থাপক: কালোটারে?
ছাগলচাষি: ওইটারে বাইরের ঘরে বাইন্দা রাখি।
উপস্থাপক: আর সাদাটারে?
ছাগলচাষি: ওইটারেও বাইরের ঘরে বাইন্দা রাখি।
উপস্থাপক: আপনি ওগুলানরে কী দিয়া গোসল করান?
ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?
উপস্থাপক: কালোটারে?
ছাগলচাষি: পানি দিয়া গোসল করাই।
উপস্থাপক: আর সাদাটারে?
ছাগলচাষি: ওইটারেও পানি দিয়া গোসল করাই।
উপস্থাপক: সবকিছু দুইটার বেলায় একই রকম করলে তুই বারবার কালোটারে-সাদাটারে জিগাস কেন?
ছাগলচাষি: কারণ, কালো ছাগলটা আমার।
উপস্থাপক: আর সাদা ছাগলটা?
ছাগলচাষি: ওইটাও আমার।

এক রাজা তাঁর প্রাসাদে একটা ঘণ্টা স্থাপন করলেন। বাইরে দড়ি থাকবে। যে-ই বিচার চাইবে, দড়ি ধরে টানবে। একদিন ঘণ্টা বাজছে তো বাজছেই, আর থামে না।

কারণ কী। দেখা গেল, এক ঘোড়া দড়ির খড় খেয়ে ফেলছে। কার ঘোড়া এটা? এক সৈনিক এই বুড়ো ঘোড়াটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বিচার বসল। সৈনিকটাকে বাধ্য করা হলো ঘোড়াটাকে ফিরিয়ে নিতে।

আমাদের কৃষকেরা আমাদের আশা দেখাচ্ছেন। আমরা আশা পাচ্ছি গরুতে। শিগগিরই আমরা আশা পাব ঘোড়াতেও।

ন্যায়বিচারের ঘণ্টাও নিশ্চয় বেজে উঠবে।

ঈদ মোবারক।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক