দুর্ঘটনা নয়, যাত্রী হত্যা!

রেজাউল করিমের মৃত্যুর ঘটনাটিকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না
রেজাউল করিমের মৃত্যুর ঘটনাটিকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না

গত সোমবার (২৭ আগস্ট) সচিবালয়ে পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শুরু হয়েছিল বেলা তিনটায়। সেই বৈঠক চলেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। একদিকে যখন চলছে নীতিনির্ধারকদের বৈঠক, অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেট এলাকায় তখন ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও সড়ক অবরোধ চলছে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে এখানে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা।

সচিবালয়ের বৈঠক শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন ঢাকায় সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘অনেক উন্নতি হয়েছে। রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়,’ তখন চট্টগ্রামের সাংবাদিকেরা নিহত রেজাউল করিমের (৩৫) স্বজনদের আহাজারির ছবি তুলছেন। মন্ত্রীর উচ্চারিত ‘উন্নতি’ শব্দটি যেন ভেসে গেল রেজাউলের মা ও স্ত্রীর চোখের জলে।

কিছুদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব এক আন্দোলনকে থামানো গেছে কিছু আশ্বাস, কিছুটাবা দমনপীড়নের মাধ্যমে। কিন্তু সড়কের বিশৃঙ্খলা বা প্রাণহানির ঘটনা থামানো যায়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি পরিবহনশ্রমিকদের বিন্দুমাত্র সমর্থন বা সহানুভূতি দেখা তো যায়ইনি, এমনকি আইনের সংস্কার বা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিও তাঁদের কোনো সমীহ আছে বলে মনে হয় না। পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের ২০টি সিদ্ধান্তও তাই শেষ পর্যন্ত ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’তে পরিণত হয় কি না, এই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে জনমনে।

রেজাউল করিমের মৃত্যুর ঘটনাটিকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। বাসচালকের সহকারীর সঙ্গে বচসার কারণে এই তরুণ যাত্রীটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বাস থেকে। বাসের অন্য যাত্রীরা শত অনুরোধ-উপরোধ করেও বাসটি থামাতে পারেনি। রেজাউলকে পিষ্ট করে দ্রুতগতিতে চালিয়ে নিয়ে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেকে নেমে পালিয়ে গেছেন চালক ও তাঁর সহকারী।

সামান্য কারণে যাত্রী বা পথচারীকে হত্যা করার ঘটনাটি নতুন কিছু নয়। এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে আরও অন্তত দুটি ঘটনার উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। গত ২১ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পায়েলকে বাস থেকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন বাসের সহকারী। যানজটের সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাস থেকে নেমেছিলেন পায়েল। এর মধ্যে যানবাহন চলতে শুরু করলে দৌড়ে বাসে উঠতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে পথিমধ্যে কোথাও কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামান্য মানবিকতা তো দেখানইনি, বরং আহত তরুণটিকে নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ‘দায়িত্ব’ সম্পাদন করেছেন বাসের সহকারী।

পরে ময়নাতদন্তে জানা গেছে, আঘাতজনিত কারণে নয়, পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটেছে তাঁর। এ ঘটনার পরদিন ২২ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এলাকায় ট্রাকের ধাক্কা লাগার প্রতিবাদ করেছিলেন আমানউল্লাহ নামের এক তরুণ। এতে ট্রাকচালক ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে এর শোধ নিয়েছিলেন।

পরপর এই তিন দুর্ঘটনা (পড়ুন হত্যা) থেকে চালকের লাইসেন্স আছে কি না বা গাড়ির ফিটনেস আছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগে চালক বা সহকারীর মানসিক ‘ফিটনেস’ নিয়েই তো প্রশ্ন উঠবে। প্রতিদিন কত হাজার যাত্রী এ রকম অসুস্থ ও খুনে মানসিকতার চালক ও সহকারীর হাতে ‘জীবনের ভার’ তুলে দিয়ে যাতায়াত করছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়!

এর কি কোনো নিদান নেই? আছে। মন্ত্রীর ভাষায় ‘রাতারাতি’ না হলেও আন্তরিক উদ্যোগ নিলে এ ব্যবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ও উন্নতি যে ঘটতে পারে, সে রকম উদাহরণও আছে আমাদের সামনে। সেই উদাহরণটি, অর্থাৎ একজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগের গল্পটা এখানে বলি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) কক্সবাজার জেলায় পুলিশ সুপার ছিলেন বনজ কুমার মজুমদার। সে সময় রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যেতে হয়েছিল তাঁকে। বাইশারির পর গাড়ি আর যায় না। ‘চান্দের গাড়ি’ নামের একধরনের পুরোনো জিপ গাড়িই এ পথে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা। এ গাড়ি খাল, ছড়া, কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে পারে। ৬ থেকে ১০ জন যাত্রী বসার ব্যবস্থা আছে গাড়িতে।

কিন্তু এতে যাত্রী বোঝাই করা হয় কমপক্ষে ৫০ জন। সামনে, পেছনে, পাশে-সর্বত্র ঝুলছে মানুষ। চালকের পক্ষে রাস্তার সামনের দিকে কিছুই দেখার উপায় নেই। সহকারী ‘ডানে-বাঁয়ে-সাইডে’ ইত্যাদি নির্দেশনা দেন, তার ওপর নির্ভর করে গাড়ি চালান চালক। এই চালকদের অধিকাংশের লাইসেন্স নেই, থাকলেও তা নকল। তার ওপর চালক ও সহকারীদের মধ্যে রয়েছে আচরণগত সমস্যা। তাঁরা রূঢ় ও মারমুখী।

ট্রাফিক আইন কী জিনিস, এই চালক ও সহকারীরা তা জানেন না। অথচ তাঁরা পাকা চালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাঁদের সংখ্যা কয়েক হাজার। বৈধ লাইসেন্স পাওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাঁদের নেই। পুলিশ কর্মকর্তা ভাবলেন, কী ‘অ্যাকশন’ নেওয়া যায়? চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাঁদের স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের দুর্গতির সীমা থাকবে না, আবার প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীও পড়বে চরম ভোগান্তিতে।

সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বনজ মজুমদার কক্সবাজার পুলিশের পক্ষ থেকে চালকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করলেন। দৈনিক ৫০ জন করে চালক এই প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন। তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করা হলো পুলিশের পক্ষ থেকে। প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিজ পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, ইসলামের দৃষ্টিতে যাত্রীসেবা, মহিলা ও শিশুর প্রতি আচরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে করণীয়, ট্রাফিক সিগন্যাল চেনা ও মেনে চলা ইত্যাদি। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ, জেলা প্রশাসক, যৌথ বাহিনীর সিও, ডিজিএফআইয়ের সিও, জেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সেক্রেটারি ও রামু কলেজের একজন শিক্ষিকা। এভাবে প্রায় ১ হাজার ১০০ চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের প্রত্যেককে পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত একটি করে সনদ দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণের প্রায় ছয় মাস পর ‘এক্সপ্লোরার’ নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই চালকদের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সমীক্ষায় উঠে এসেছে-১. পুলিশ সুপারের সনদটি তাঁরা সযত্নে গচ্ছিত রেখেছেন, ২. গাড়ি চালানোর সময় তাঁরা এখন লুঙ্গির পরিবর্তে প্যান্ট পরেন, ৩. প্রত্যেক চালক ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটি লুঙ্গি, একটি গামছা ও একটি সাবান সঙ্গে রাখেন। এসব জিনিস অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেন না। অন্যের ব্যবহৃত জিনিসও তাঁরা ব্যবহার করেন না,৪. স্কুল-কলেজের সামনে গেলে নিজের সন্তান, ছোট ভাইবোন ও পরিবারের কথা মনে করেন, ৫. নারীদের সঙ্গে তাঁদের আচরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, গাড়িতে ওঠা নারীদের প্রতি তাঁরা সহযোগিতামূলক আচরণ করেন ইত্যাদি। দুর্ঘটনার হার যে আগের তুলনায় অনেক কমেছে, তারও হিসাব তুলে ধরেছিল বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি।

এ কথা তো সত্য, ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে যেখানে ১৬ কোটি মানুষের বাস, সেখানে পরিবহনের ক্ষেত্রে রাতারাতি ব্যাপক উন্নতি ঘটবে, সেটা আশা করা যায় না। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ নিলে যে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে, কক্সবাজারের ঘটনাটি তার একটি দৃষ্টান্ত। চালক, সহকারী, যাত্রী ও পথচারী-সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা ও মানসিক পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগটা নিতে হবে সবার আগে। পাশাপাশি এ খাতে দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১ থেকে ২০ আগস্ট-এই ২০ দিনে বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয় থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। কর্মঘণ্টা হিসাব করলে প্রতি ৪২ সেকেন্ডে ফিটনেস পেয়েছে একটি করে যানবাহন। এই অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির মধ্যে যে অনিয়ম বা দুর্নীতি আছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

পথে-ঘাটে মানুষ মরছে পোকামাকড়ের মতো। প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একেকটি পরিবারের করুণ অধ্যায়। একটি সভ্য সমাজে এই মানবেতর অবস্থা চলতে পারে না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]