ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে খাপ্পা কেন ট্রাম্প?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে হয় মানুষের ওপর গবেষণা চালানোর বিষয়টি খুব উপভোগ করছেন। তিনি তাঁর প্রথম গবেষণাটি চালান শিশুদের ওপর। চলতি বছরের মে মাসে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিকে (আইসিই) অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা লোকজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা শিশুদের অন্য স্থানে রাখার নির্দেশ দেন। এসব শিশুকে যেখানে রাখা হয়েছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই বন্দিশালা এবং মা-বাবার অনুমতি ছাড়াই অনেক শিশুকে মনোরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ খাওয়ানো হয়। মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসব শিশু অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে।

ট্রাম্পের সর্বশেষ গবেষণার শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক যে সংস্থাটি ৭০ বছর ধরে গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানের ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর জীবন রক্ষায় সাহায্য দিয়ে আসছিল, সেই ত্রাণ সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ ওয়ার্কস অ্যান্ড এজেন্সিকে (ইউএনআরডব্লিউএ) সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।

ইউএনআরডব্লিউএর মুখপাত্র ক্রিস গানেস ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত ৫ লাখ ২৬ হাজার শিশুর জীবনের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যারা ইউএনআরডব্লিউএর সহায়তায় পড়ালেখা করছে। এ ছাড়া যে ৩৫ লাখ অসুস্থ মানুষ, যারা চিকিৎসার জন্য আমাদের ক্লিনিকগুলোতে আসে এবং যে ১৭ লাখ মানুষ আমাদের কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে, তারা মারাত্মক অসুবিধায় পড়বে। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র এত দিন যে পরিমাণ সহায়তা দিয়ে আসছিল, এখন যদি অন্য রাষ্ট্রগুলো তা পূরণ না করে, তাহলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।

ট্রাম্পের এই গবেষণার দুটি স্পষ্ট লক্ষ্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে ট্রাম্প দেখতে চান যে ধ্বংস করার নীতি এবং মানবতাবিরোধী হস্তক্ষেপ ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তির কিছু অংশের বিপরীত, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়েরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্পগুলোতে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

অসলো শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যেসব এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেসব এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষের লালন-পালনের দায়িত্ব থেকে ইসরায়েলকে মুক্তি দিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ট্রাম্পের বর্তমান উদ্দেশ্য হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করতে
বাধ্য করা। যখন ট্রাম্প ইউএনআরডব্লিউএকে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করার ঘোষণা দেন, ঠিক একই সময়ে তিনি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকেও সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এটাকে কাকতালীয় ঘটনা বলা যাবে না। এই কৌশল গ্রহণের উদ্দেশ্য খুবই সহজ—ফিলিস্তিনিদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করা।

ট্রাম্পের গবেষণার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী মর্যাদা বিলুপ্ত করা। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর জন্য ইউএনআরডব্লিউএ গঠন করা হয়। এসব শরণার্থী তাদের গ্রাম বা শহর থেকে পালিয়ে আসে বা তাদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করা হয়। এই নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে ইসরায়েল এসব ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িতে
ফিরতে দেয়নি। আর এভাবে ইসরায়েল শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করেছে।

সেই সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বংশধরদের সংখ্যা এখন ৫০ লাখের বেশি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কল্পিত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে ট্রাম্পও বলেছেন যে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার চেয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলছে। তিনি এখন বলছেন, ১৯৪৮ সালের আগে যঁারা ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং যাঁদের বয়স এখন ৭০ বছরের বেশি, শুধু তাঁদেরই শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তাঁদের বংশধরেরা শরণার্থীর মর্যাদা পাবে না।

২০ শতকে কম্বোডিয়া থেকে চীন পর্যন্ত এবং গোটা ইউরোপে মানুষের ওপর এ রকম গবেষণা হতে দেখা গেছে, যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। দুঃখজনকভাবে ট্রাম্প ইতিহাসের ছাত্র নন। তিনি শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করার জন্য ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ওপর এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। তবে এটা আসলে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। আল-জাজিরা থেকে নেওয়া

নেভে গর্ডন: লন্ডনের কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক