নির্বাচন ভুটানে, উদ্বেগ নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ে

ভুটান সীমান্তের দোকলাম নিয়ে চীন ও ভারতের রেষারেষি এখন গড়িয়েছে থিম্পুতে কার প্রভাব বেশি থাকবে তা নিয়ে। ছবি: এএফপি
ভুটান সীমান্তের দোকলাম নিয়ে চীন ও ভারতের রেষারেষি এখন গড়িয়েছে থিম্পুতে কার প্রভাব বেশি থাকবে তা নিয়ে। ছবি: এএফপি

ভুটানে রাস্তাঘাট নির্মাণে ভারতীয় একটি উদ্যোগ হলো ‘প্রজেক্ট দানতাক’। থিম্পুতেই তাদের কার্যালয়। এটি ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের ‘বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন’-এর (বিআরও) একটি প্রকল্প, যা ১৯৬১ সাল থেকে চলছে। এ পর্যন্ত তারা দেশটিতে অনেক নির্মাণকাজের পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছে। ভুটানের অবকাঠামো উন্নয়নে এই সংস্থা নিজের কাজ নিয়ে বিশেষ গর্বিত। কিন্তু গত জুলাইয়ে দানতাক বিব্রত অবস্থায় পড়ে যখন ভুটান সরকার তাদের তৈরি রোড সাইনগুলো প্রত্যাহার করতে বলে। দানতাক এসব সাইন তৈরি করেছিল ভারতীয় পতাকার রঙে। এ নিয়ে ভুটানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করলে সরকারও প্রতিকারে নামে। তরুণেরা মনে করছিলেন, এভাবে তাঁদের দেশকে যত্রতত্র ভারতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে দানতাক একে একে প্রতিটি প্রতীক থেকে ভারতীয় পতাকার রং মুছতে শুরু করে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এই খবর সামান্যই এসেছে।

দানতাকের এই অভিজ্ঞতা আপাত অর্থে রাজনৈতিক তাৎপর্যহীন মনে হলেও এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এপ্রিলে পারো বিমানবন্দর থেকে একটি সাইনবোর্ড সরাতে বিআরওকে বাধ্য করা হয়—যেখানে লেখা ছিল ‘দানতাক আপনাকে ভুটানে স্বাগত জানাচ্ছে’। তারও আগে থিম্পু-পুয়েন্টশোলিং মহাসড়কের অনুরূপ এক বোর্ড থেকে ‘ভারত সরকার’ লেখা মুছতে হয়।

যদিও সমগ্র বিশ্ব জানে, ভুটানে নয়াদিল্লির ইচ্ছাই চূড়ান্ত, কিন্তু সেই জানাশোনায় সংশোধন জরুরি এখন। ভুটানের নাগরিকেরা ক্রমে ভারতীয় প্রভাব নিয়ে স্পর্শকাতর আচরণ করছে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দেশটির উদীয়মান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, যা এক দশক পেরিয়ে ১১তম বছরে পা দিল।

তৃতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এল
১৫ সেপ্টেম্বর ও আগামী ১৮ অক্টোবর ভুটানে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। দেশটির প্রধান বিচারপতি এই সরকারের প্রধান হিসেবে আছেন।

২০০৭ সালে ভুটানে প্রথম নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শুরু এবং বাধাহীনভাবে তা চালু আছে। নির্বাচনী সংস্কৃতি যতই এগোচ্ছে, দেশটিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চেতনা ততই বিকশিত হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নীরব একটি বিবেচনা হয়ে উঠছে কোন দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন। ভুটান চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে কি না এবং না করার কী কারণ থাকতে পারে—এরূপ গুঞ্জনও নির্বাচনী প্রচারণায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে।

ভুটানে সাধারণত দুই দফায় ভোট হয়ে থাকে। প্রথম দফায় ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয়। যে দুই দল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পায়, তারা পার্লামেন্টের ৪৭টি আসনে প্রার্থী দেয় এবং তখন দ্বিতীয় দফা ভোট হয়। এবারের প্রথম দফা ভোটে চারটি দল অংশ নিচ্ছে।

চীন-ভুটান সম্পর্ক
গত বছর দোকলামে চীন ও ভারতের মাঝে ৭৩ দিনের সামরিক উত্তেজনার পর ভুটান নিয়ে চীন-ভারত স্পর্শকাতরতা অনেক বেড়ে গেছে। চীন নানান উপায়ে হিমালয় রাজ্য ভুটানে প্রবেশ করতে তৎপর। আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক চাইছে তারা। ভুটানও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তবে ভুটানের সরকারের (তখন প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে) ওই ধরনের মনোভাবের কারণে ২০১৩ সালের নির্বাচনকালে ভুটানে সরবরাহ করা গ্যাসে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং ভোটাররা যাতে ভারত-সমর্থক দলকে ভোট দেন, সে জন্যই ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। যথারীতি তা-ই হয়। গ্যাসের ভর্তুকি ফিরে পাওয়ার আসায় নিরুপায় ভোটাররা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ভোট দেন। ৪৭টির মধ্যে ৩২ আসন পায় তারা। হেরে যায় ডিপিটি নামে পরিচিত পূর্বতন শাসকদল ‘দ্রুক পুয়েনসাম তসগপা’। যদিও প্রথম দফা ভোটে তারা সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে ডিপিটি আরেকটু ভালো করতে তৎপর। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাসেরিং তবগায়েকে তারা ‘প্রো-ইন্ডিয়ান’ হিসেবে তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী তরুণদের ভোট পেতে চাইছে। তাসেরিং এই পরিস্থিতি সামাল দিতে খোলামেলাভাবেই আরও ভারতমুখী অবস্থান নিয়েছেন।

ভুটানের নির্বাচনী প্রচারণার একটি সুন্দর দিক হলো অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা একত্র হয়ে নীতিগত বিষয়ে বিতর্ক লিপ্ত হন। এবার বিতর্ককালে মূলত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল। জ্বালানিতে পরনির্ভরতা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক চলছে। চীন-ভারত প্রসঙ্গ সেখানে সামান্যই এসেছে। নির্বাচনে ভারতের বিরোধিতা এড়াতে সব দল মেনিফেস্টোতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তবে নির্বাচনকে ঘিরে নয়াদিল্লি উদ্বেগমুক্ত নয় এবং বেইজিংও কূটনীতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। চীনের সহকারী বিদেশমন্ত্রী কং ইউয়ানইউ গত জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহে তিন দিন ভুটান সফর করেছেন।

চীন মনে করছে, যেভাবে তারা ধীরে ধীরে নেপাল ও মালদ্বীপকে ভারতের একচ্ছত্র প্রভাববলয় থেকে মুক্ত করতে পেরেছে, ভুটানের ক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব হবে। স্থানীয় কিছু রাজনীতিবিদ ভারতের ওপর একক নির্ভরতার বিপদ উপলব্ধি করছেন বলেই চীনের ধারণা। ভুটান-চীন সরাসরি বিমান যোগাযোগ নেই, চীন যেতে হলে নেপাল গিয়ে ভিসা নিতে হয়—এসব ভুটানের তরুণদের কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করছে।

চীনের সুবিধা হলো, ভুটানের শাসকশ্রেণিও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। ফলে উভয় দেশের সাংস্কৃতিক সম্ভাবনা দেখছে তারা। ‘সফট ডিপ্লোমেসি’ হিসেবে চীন থেকে ফুটবল ক্লাব, অ্যাক্রোব্যাট দল নিয়মিত যাচ্ছে থিম্পুতে। ভুটানের প্রচুর শিক্ষার্থীকে চীন বিনে পয়সায় পড়ারও সুযোগ করে দিচ্ছে। চীন থেকে ভুটানে পর্যটক আসার পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। তবে সেটা এখনো ভারতীয়দের চেয়ে অনেক কম।

তবে ভারতকে কোণঠাসা করতে সম্প্রতি সীমান্ত বিবাদ নিরসনে চীন ভুটানকে দারুণ এক ছাড়ও দিয়েছে। উত্তর ও পশ্চিম ভুটান সীমান্তসংলগ্ন বিবাদিত প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার দাবি ছেড়ে দিয়েছে চীন। বিনিময়ে চেয়েছে ভারত-ভুটান-চীন সীমান্ত যেখানে মিলিত হয়েছে, সেই দোকালামসংলগ্ন ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। এই প্রস্তাব ভুটানের জন্য লাভজনক হলেও ভারত একে উসকানিমূলক মনে করছে।

দোকালাম এলাকাটি সিকিমসংলগ্ন। ভারতের শিলিগুড়ি করিডর থেকেও এটা সন্নিকটে। চীনকে এখানে কর্তৃত্ব করতে দিতে অনিচ্ছুক ভারত। শুধু ভারতের আপত্তির কারণে চীনের প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারছে না থিম্পু। ভুটান-চীন সীমান্ত আলোচনায় ভারতের প্রভাব এ মুহূর্তে অচলাবস্থা জারি করে রেখেছে। এই অবস্থা ধরে রাখতেই ভুটান-চীন সম্পর্ক উন্নয়নে উৎসাহী রাজনীতিবিদদের আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দেখতে চায় না নয়াদিল্লি। তাদের পছন্দ পিডিপি। শঙ্কা ডিপিটিকে নিয়ে। ডিপিটি বাণিজ্যে ভারতনির্ভরতা কমিয়ে চীনকেও কাছে টানতে ইচ্ছুক। এ মুহূর্তে ভুটানের ব্যবসায়িক বিনিময় শতকরা ৮০ ভাগই ভারতনির্ভর এবং দেশটির আয়ের প্রধান উৎস হয়ে আছে ভারতের কাছে জলবিদ্যুৎ বিক্রি। কিন্তু তাতে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।

ভুটান যে কারণে চীনের জন্য চ্যালেঞ্জ
ভুটান-চীন সীমান্ত প্রায় ৪৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এরূপ একটি প্রতিবেশীর সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক নেই, স্থল সীমান্ত বাণিজ্য যোগাযোগও অতি নগণ্য—এটা চীনের জন্য বিশেষ হতাশার ব্যাপার; বিশেষ করে যখন তারা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।

চীন মনে করে, থিম্পুতে তার অনুপস্থিতি খুবই বেমানান। ফলে যেকোনো মূল্যে ভুটানে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা এ মুহূর্তে চীনের দক্ষিণ এশিয়া নীতির অগ্রাধিকার। ভারত এটা চাইছে না। ভুটান বিষয়ে ভারতের কূটনীতি এখনো ১৯৪৯ সালের চুক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ২০০৭ সালে এই চুক্তি ভুটানকে কিছু কূটনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু দিল্লি মনে করে, ভুটানের বিদেশনীতি ভারতের ইচ্ছাধীন থাকা প্রয়োজন। ভারতের এই অবস্থানের কারণে জাপান ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তি কারও সঙ্গে ভুটানের যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। ভুটানিরা এখন আর এটা মেনে নিতে প্রস্তুত নেই। চীনের জন্যও তা অসহনীয়। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র দেশ, যেখানে চীনের পণ্য বাণিজ্য অনেকখানি থমকে আছে। ফলে চীনের বিদেশনীতির সামনে এ মুহূর্তে ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা মুখ্য এক চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে তারও প্রয়োজন আসন্ন নির্বাচনে সেসব রাজনীতিবিদের বিজয়, যারা ভারতীয় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থেকে খানিক ভিন্ন বাতাসে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছুক। মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কা-নেপালের পর ভুটান তাই চীন-ভারত ঠান্ডাযুদ্ধের সর্বশেষ ফ্রন্টিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক