এক চোখে নির্বাচন, অন্য চোখে আদালত

কোনো তর্ক হলেই আমরা বলি, আইনে কোথায় কী আছে। শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেছেন, দেশে কত মামলা। জেনারেল এরশাদ মঞ্জুর হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। সেই বিচারের খবর নেই। আরও কত মামলা আছে, তার গতি জানি না। আবার কোনো কোনো মামলার অসম্ভব গতি। তাই যেখানেই ‘তড়িঘড়ি’ সেখানেই একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয় থাকতে পারে বলে আমজনতার মনে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতেই পারে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়েছেন বলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলারও রায় দ্রুত হতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। আবার এই যে ‘আইনে নেই’ প্রসঙ্গটি তোলা হলো, সেটা কি সংবিধানসম্মত? কেউ সংবিধান দেখিয়ে বলতে পারেন, দ্রুত বিচার তো প্রত্যাশিত। দ্রুত আর তড়িঘড়ির মধ্যে কী পার্থক্য? রাষ্ট্র বলবে দ্রুত, আসামিপক্ষ বলবে তড়িঘড়ি। কিন্তু কখনোই আইনের আপন গতিকে আমরা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আলাদা করতে পারি না। মঞ্জুর হত্যার মতো আর কত মামলা আছে, সেখানে রাষ্ট্রের কাছে আমরা দ্রুত বিচার চাই। কিন্তু রাষ্ট্র তা চায় না। সুতরাং রাষ্ট্র যখন দ্রুত বিচার বলে, তখন আমরা ন্যায়বিচারই বুঝব, তেমনটা সত্য নয়, বাস্তবতা নয়।

আগামী অক্টোবরে নির্বাচনী তফসিল হতে পারে। তার আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। এখন সবার চোখ আটকে থাকার কথা কেবল নির্বাচনের দিকে। অথচ সবার চোখ এখন আদালতের দিকেও। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলাগুলোর রায় এগিয়ে আসছে। এবার এই যে একটি পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেটা কতটা সুচিন্তিত, কতটা কাকতালীয়, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তবে অনেকে যাঁরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে বিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে পদাধিকারবলে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান বাতিল করে আমরা প্রাক্নির্বাচনী রাজনীতিতে আদালতকে অপ্রাসঙ্গিক করব; তাঁদের ভুল ভাঙছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের অনেক আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন আদালত। কিন্তু দুই মেয়াদে সংসদ নির্বাচন করার বিধান করায় আদালত নির্বাচনী রাজনীতিতে আলোচনার খোরাক ছিলেন। এখন আশঙ্কা করি, আদালত সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবেন। কারণ, বিচার বিভাগ চলমান ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে, এটা আর পিছু ছাড়বে বলে মনে হয় না।

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদটি অনেক দিন পর দুই বড় দলের বিবদমান বড় নেতাদের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। মওদুদ আহমদ বলেছেন, ৩৫ (৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, অভিযুক্ত প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী। এখন প্রকাশ্য শব্দটি কীভাবে ‘ক্যামেরা’ বা গোপন বিচার হলো, সেটা একটা প্রশ্ন। কারাগারে আদালত বসানোর অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংবিধানের কোথায় আছে, কারাগারে আদালত বসানো যাবে না। কেউ হয়তো যুক্তি দেবেন, একটা উত্তর তো তাঁর প্রশ্নেই রয়েছে। একটি কক্ষ যদি ‘কারাগার’ হিসেবেই আইন দ্বারা নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে সেই একই কক্ষ বা স্থান কী করে আইন দ্বারা ‘আদালত’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার আইন দ্বারা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সেই এলাকার একটি অংশকে আইন দ্বারা ‘সাবজেল’ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানি না।

নব্বইয়ের আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর গুলশানের একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে এরশাদকে এবং নিকট অতীতে সাবজেল ঘোষণা করে দুই নেত্রীকে রাখা হয়েছিল। সামরিক আমলে কর্নেল তাহেরের বিচার কারাগারে হয়েছিল। সেই বিচার ইতিহাসে নিন্দিত হয়েছে। পরিত্যক্ত কারাগারের একটি অংশকে কেন সাবজেল করতে হলো, তাতে শুধু ‘আইন’ নেই, রাজনীতিও আছে। এরশাদ গুলশানের সাবজেলে ‘আরামে’ আছেন, এর বিরুদ্ধে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা তপ্ত বক্তৃতা করেন। এর পরপরই এরশাদকে নাজিমুদ্দিন রোডের এই কারাগারেই সেদিন তড়িঘড়ি করে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

তবে এই প্রসঙ্গে আমরা আরেকবার স্মরণে আনব যে ৩৫ (৩) অনুচ্ছেদটি বলেছে, ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।’ ১৯৯০ সালের পর সংবিধানে সাতটি সংশোধনী আনা সত্ত্বেও ৩৫ (৩) অকার্যকর থেকেছে। ‘প্রত্যেক ব্যক্তি’-র জন্য অভিন্ন কোনো পন্থা নেই। গ্রেপ্তার, জামিন কিংবা বিচার যা-ই বলুন, ‘কারও জন্য দ্রুত কারও জন্য শম্বুক’, গত প্রায় তিন দশক এটাই বাস্তবতা। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি রাজনীতিক হন, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মামলায় দ্রুত কিংবা ঢিমেতালের মাত্রাটা ঠিক করে দেবে। কিন্তু দুই দলই নাগরিকের দ্রুত বিচার লাভের মৌলিক অধিকার প্রকারান্তরে নিজস্ব রাষ্ট্র বিবেচনায় পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার করে চলছে। এর প্রমাণ, তারা অভ্যাসগতভাবে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ও বিচারপতি নিয়োগের আইন করেনি।

এটা মনে রেখে সচেতন নাগরিকেরা কারাগার বা আদালত বিষয়ে উতলা বা নিরাসক্ত থাকবেন। সরকারি আদেশ আদালত স্থানান্তরের কারণ হিসেবে বলেছে, ‘বর্ণিত বিচার কার্যক্রম চলাকালীন এলাকাটি (আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ) জনাকীর্ণ থাকে বিধায় নিরাপত্তাজনিত কারণে’ ১২৫ নম্বর নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নং ৭-এর অস্থায়ী আদালতে বিচার কার্যক্রম চলবে। কারাগারের কোনো অংশকে আদালত বলা যায় কি না, এর আইনি দিকের চেয়ে জোরালো হলো রাজনৈতিক দিক। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, ১৪টি হাজিরার তারিখে জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় খালেদা জিয়া গরহাজির ছিলেন। দণ্ডিত হওয়ার পর তিনি আর যাননি।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কয়েক মাসের ব্যবধানে ১৪টি তারিখ পড়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে অতীতের আর কোনো দুর্নীতি বা অপরাধের মামলা, যাতে ক্ষমতাসীন দল বা তার আশীর্বাদপুষ্ট কেউ জড়িত আছেন, সেসব ক্ষেত্রে আমরা এমন গতি দেখি না। সুতরাং প্রতিপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সত্যতা কমবেশি আছে। উভয়ের এই অবস্থান আইনের শাসনকে আঘাত করে। নাগরিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জিয়া চ্যারিটেবলে খালেদা জিয়ার কৌশল সরকারি মহলকে কোণঠাসা করতে পারে। কারণ, জামিনে থেকে আদালতে না এলে তাঁকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা সম্ভব ছিল। এখন ‘যত খুশি সাজা দিন’ বলে সত্যি আর না এলে তাঁকে পলাতক বলা যাবে না। আবার আসামিপক্ষকে না শুনে রায় ঘোষণা করাও সহজ হবে না। সুতরাং এই মামলাটি আটকে গেলেও যেতে পারে।

এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কেন জানি গতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী ডামাডোলে তা ‘আপন গতি’ পেয়েছে বলে মনে হয়। ১২ সেপ্টেম্বরে রায় ঘোষণার তারিখ জানা যেতে পারে। তবে আদালত-বিষয়ক ও নির্বাচনমুখী এসব অগ্রগতির মধ্যে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার দুর্নীতির মামলার একটি রায় ঘনিয়ে আসছে। এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, দণ্ডিত থেকেও তিনি জামিনে আছেন বলে তাঁর মন্ত্রিত্ব বহাল আছে। তাঁর দণ্ড কোনো কারণে বহাল থাকে, তাহলে তফসিল ঘোষণার পর খালেদা জিয়া ও মায়ার আইনি অবস্থান একই হবে। যদি আদালতে তাঁর দণ্ড চলে যায়, তাহলে খালেদা জিয়া ও তাঁর অবস্থান এক থাকবে না। খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত হয়নি। তাই আশঙ্কা আছে, এ কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে। এমনতর অনুশীলনের পক্ষে রায় আছে। আবার নিতান্ত আপিল করেও নির্বাচন করার নজির আছে। দুই ধরনের রায় আছে।

সুতরাং আমরা একটা সময় পার করতে যাচ্ছি, যখন এক চোখে নির্বাচন, অন্য চোখ আদালতেই আটকে থাকবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]