মানুষের জন্য বিজ্ঞান: গবেষণা পুরস্কার-২০১৮

বিজ্ঞানচর্চার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে অজানাকে জানার চেষ্টা, অপরটি হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে মানুষের জীবনের মান উন্নত করা। নিয়ন্ত্রিতভাবে আগুন জ্বালানোর প্রযুক্তি যেদিন মানুষ আবিষ্কার করে, সেদিন থেকেই মানুষের সভ্যতার শুরু মনে করা হয়। এ জন্য ‘সভ্যতা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল’, এক কথায় বলা যায়। আবার প্রযুক্তির উন্নয়ন এমন সব যন্ত্রপাতি উন্নয়নে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে অজানাকে জানার পদ্ধতিকে আরও উন্নত করে বিজ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। সে উন্নত বিজ্ঞান আরও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মানুষের জীবনের মানকে আরও বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এভাবে হাত ধরাধরি করেই চলে আসছে আদিকাল থেকে।

পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি—এ দুটি দিকেই একসঙ্গে গবেষণা হয়ে দুটি দিকই উন্নত হয়েছে। ফলে, জনসাধারণের জীবনের গুণমান সামগ্রিকভাবে উন্নত হয়েছে আবার পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন বিজ্ঞানের কৌতূহলের দিকটিকেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে আমাদের প্রাচ্যের দেশগুলোয় জীবনের মান উন্নয়নের প্রযুক্তি কেবল যে উপেক্ষিত হয়েছে তা নয়, এ ধরনের প্রচেষ্টাকে সামাজিকভাবেও নিচু চোখে দেখা হয়েছে। যদিও মধ্যযুগের আরব বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তি ও জ্ঞানের বিকাশে ইউরোপের সামনে পথিকৃতের ভূমিকায় এসেছিলেন, কিন্তু আজ যেন চলছে উল্টোযাত্রা। এর ফলাফল পরিষ্কার। প্রযুক্তিবিবর্জিত হয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিণত হয়েছে জ্যোতির্বিদ্যায়, যেটি মোটেই আর বিজ্ঞান থাকেনি, ভূত-ভবিষ্যৎ গণনা করার দিকে চলে গেছে। অন্যদিকে, দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির অভাবে বৃহত্তর জনসাধারণের জীবন-মান অতীতের মতোই রয়ে গেছে। বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির সুফল তারা পাচ্ছে খুব সামান্যই। সব মিলিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের স্থান কোথায়, তাও পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে না। মানবগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগের জন্য এ একই চিত্র, যারা আজ তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ অধিবাসী। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনকে সামনে রেখে, তাদের উপযোগী করে স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করে ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন আসবে না।

সারা তৃতীয় বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও বৃহত্তর জনগণ যুগ যুগ ধরে তাদের পরিশ্রম থেকে আহরণ করা সম্পদের অনেকখানি নিজেরা ব্যবহার না করে আমাদের স্বল্পসংখ্যক মানুষকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করার জন্য তুলে দিয়েছে, সীমিত হলেও গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের মনে আশা, অর্জিত এ জ্ঞান-বিজ্ঞান ব্যবহার করে এ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের সব মানুষকে উন্নত জীবনে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু আমরা, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সাধারণ জনগণের সে ত্যাগের বিনিময় দিতে ব্যর্থ হয়েছি। উল্টো, চড়া মূল্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে নিজেদের জীবনের মান বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য অর্থনীতিকে সাজিয়ে নিয়েছি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যুগের পর যুগ বঞ্চিতই রয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে দেশের সাধারণ জনগণের জীবনের মান উন্নয়নে নিয়োজিত করা আমাদের শিক্ষিত জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্বের বোধ আমাদের তরুণদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার জন্য ‘মানুষের জন্য বিজ্ঞান’ শিরোনামে এ গবেষণা পুরস্কার চালু করা হয়েছে। পুরস্কারের ব্যবস্থাতেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। অপর একজনকে পিছে ঠেলে ফেলে নিজে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়—এ ধরনের একটি অসুস্থ মানসিকতা তৈরি করছে এখনকার প্রতিযোগিতাগুলো। তাই প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি না দিয়ে তিনটি স্তরে পুরস্কার দেওয়া হবে—যথাক্রমে উত্তম, মধ্যম ও সন্তোষজনক। একটি স্তরে একাধিক প্রকল্পকে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।

১৫ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক কার্জন হল ভবনে একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয়ীদের বেছে নেওয়া হবে। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মিলে প্রকল্পগুলো বিচার করবেন। পাশাপাশি প্রদর্শনীতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানও অংশগ্রহণ করবে। সকাল সাড়ে নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে। বেলা ১১টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সাধারণ দর্শকের জন্য প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে। বেলা ৩টায় পুরস্কার বিতরণী ও বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ করা হবে। science4mankind.net ওয়েবসাইটে বিশদ দেওয়া আছে।

নতুন ধরনের এ পুরস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে। এডওয়ার্ড এম কেনেডি (ইএমকে) সেন্টারের সার্বিক সহযোগিতায় এ আয়োজন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্স সোসাইটি এবং রিলেভেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সোসাইটি-বাংলাদেশ। গণমাধ্যম পার্টনার হিসেবে রয়েছে চ্যানেল আই, মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা এবং রেডিও একাত্তর 98.4 FM আর গণমাধ্যম সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রথম আলো।

আশা করা যায়, এতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়বে, জনগণ উপকৃত হবে। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের ধারাকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলার এই চেষ্টা যাতে চালু থাকে, সেই প্রত্যাশা রাখি।

ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী: সাম্মানিক অধ্যাপক, বায়োমেডিক্যাল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়