গায়েবি মামলা

পুলিশ নাগরিক জীবনের এক অবিভাজ্য নাম। পুলিশের চাকরি প্রকৃতপক্ষে একটি সেবা। তাই পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ ইদানীং যেভাবে গায়েবি মামলা করা শুরু করেছে, তাতে তার মলিন ভাবমূর্তি যে আরও বেশি মলিন হবে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

কিশোর আন্দোলনের পরে আমরা পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকায় দেখতে চেয়েছি। সভ্য সমাজে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা আইনের কঠোরতা ও তার প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে না। জনগণ তাকে কী চোখে দেখে, তার ওপর পুলিশের মানমর্যাদা সরাসরি নির্ভরশীল। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ পুলিশ অনেকটাই পিছিয়ে। এখন গাজীপুরের দুই থানায় যেভাবে বিদেশে থাকা বিএনপি নেতাদের ভাঙচুর মামলার আসামি করেছে এবং এর আগে রাজধানীর চকবাজারে মৃত ব্যক্তিকেও পুলিশ যেভাবে ককটেল ছুড়তে দেখেছে, তা আমাদের বিচলিত করে। আশঙ্কা জাগছে, পুলিশ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে কি না।

আমরা বিশ্বাস করি, পুলিশের সচেতন ও বিবেকবান অংশের মধ্যে একটা রক্তক্ষরণ, একটা আত্মজিজ্ঞাসা আছে। কারণ, পেশাদারত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ দুর্বল হতে বাধ্য। অবশ্য পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোকেই বহুলাংশে দায় কাঁধে নিতে হবে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসানের পর আমরা আশা করেছিলাম, পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহারের রাশ টানা সম্ভব হবে। কিন্তু জাতি ধীরে ধীরে হতাশ হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর বিভিন্ন পর্বে আমরা সেই একই ধারাবাহিকতা এবং সেই সঙ্গে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা পর্যায়ক্রমে নিচে নামা প্রত্যক্ষ করেছি।

কিন্তু সাম্প্রতিক কালে পুলিশ প্রশাসনের কোনো কোনো অংশ যেভাবে বিরোধী দল বা ভিন্নমত দমনে অতি মনোযোগী হয়েছে, তাতে নতুন করে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কোনো কোনো ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, তারা যেন আইন ভঙ্গ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর আগে আমরা ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি ধরার নামে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ গ্রেপ্তার কিংবা মানুষকে অযথা হয়রানির বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু আমরা আশাহত যে সেই পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হলেও এখন তার আরও অবনতির আভাস মিলছে।

নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হয়রানিমূলক মামলা জন্ম নিচ্ছে, যেন তার একটা উদ্দেশ্যই থাকে সর্বাধিক সংখ্যক বিরোধীদলীয় কর্মীকে হয়রানি করা। এ ধরনের মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন না দিয়ে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখে। এর ফলে পুলিশ বাদী মামলার সংখ্যা বাড়ার অনুপাতে অভিযোগপত্র দেওয়া বা তদন্তের নিষ্পত্তির হার বাড়ছে না। ৩৩ লাখ বিচারাধীন মামলার ভারে জবুথবু আমাদের বিচার বিভাগের ওপর পুলিশ বিভাগ ক্রমবর্ধমান হারে ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর কোনো দায় নিচ্ছে না। তাদের এ জন্য কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না।

আমরা দেখছি উচ্চ ও নিম্ন আদালতে এখন জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির বিষয়টি মূল কার্যক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারের বিষয়টি অনেকটাই যেন গৌণ হয়ে পড়ছে। সত্যিকারের বিচারব্যবস্থায় এমন চলতে পারে না। এটা সমাজে পেশিশক্তি এবং অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। বিরোধী দল নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত থাকতেই পারে। কিন্তু আইন অনুযায়ী আচরণ পাওয়া প্রত্যেক অভিযুক্তের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, বহু মানুষ জামিনের আশায় দিগ্‌বিদিক ছুটছে। কেউ এলাকাছাড়া অবস্থায় রয়েছে। কেউ হয়তো ঝুঁকি নিয়েও বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। পুলিশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে তারা অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী নয়। নিঃসন্দেহে গায়েবি মামলার আধিক্য বিশ্বাসহীনতার জন্ম দেবে। আর মানুষের মন থেকে উঠে গেলে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে পুলিশের আর কিছু থাকে না।