জাল ফেলে আলো ধরা যায় না

নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে তরুণদের ভোট বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে
নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে তরুণদের ভোট বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে

প্রথম আলোর এই মতামত বিভাগে ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত রেহমান সোবহানের ‘শিশুদের বিপ্লব থেকে কী শিখলাম’ রচনার এই কথাগুলো মর্মের মধ্যে বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ‘এই বৃদ্ধ বয়সে আমার রাজনৈতিক অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমি শুধু এই আশাই করতে পারি, তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের হাতে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করার সময় এখনো আছে। পেশিশক্তি দিয়ে জনগণের আন্দোলন দমন না করে তাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন জয়ের সময় এখনো আছে।’

রেহমান সোবহান তাঁর লেখা শেষ করেছেন এভাবে, ‘কোনো এক প্রাচীন ঋষি তাঁর অনুসারী নৃপতিদের উদ্দেশে কয়েকটি বাণী দিয়েছিলেন। সেগুলো আমাদের এই সময়েও প্রাসঙ্গিক। সেগুলো হলো: সত্যিকারের শত্রুদের থেকে সত্যিকারের বন্ধুদের আলাদা করতে শেখো। শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করার চেষ্টা করো। এটা নিশ্চিত করো, তোমার বন্ধুরা শত্রুতে পরিণত হবে না।’

অধ্যাপক রেহমান সোবহান কোন ঋষির কথা বলেছেন, জানি না। ড. অমর্ত্য সেন নিজের লেখায় কনফুসিয়াস কিংবা অশোক বা কৌটিল্য থেকে উদ্ধৃতি দেন, তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেন। উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা বইয়ে অমর্ত্য সেন লিখেছেন জিলু এবং কনফুসিয়াসের কথোপকথন প্রসঙ্গে। জিলু বা ঝং ইউ (৫৪২-৪৮০ খ্রিষ্টপূর্ব) ছিলেন কনফুসিয়াসের সবচেয়ে অনুগত শিষ্য। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘জিলু যখন তাঁকে শুধায়, “রাজপুত্রের সেবায় কী করণীয়? ” কনফুসিয়াসের উত্তর ছিল, “তাঁর কাছে সত্য উদ্ঘাটন করবে, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট হলেও। ” আজকের দিনে বেইজিং বা সিঙ্গাপুরের সেন্সরদের ধারণা অন্য রূপ হতে পারে। কনফুসিয়াস অবস্থার বিচারে সতর্কতা এবং বিচক্ষণতা সমর্থন করতেন কিন্তু কুশাসনকে কখনো সমর্থন করেননি। রাষ্ট্র যদি যথার্থ পথে চলে তাহলে সাহসভরে কথা বলবে এবং কাজ করবে। রাষ্ট্র যদি ভুল পথে চলে সাহসভরে কাজ করবে এবং কথা বলবে।’

এবার আসব আহমদ রফিকের কথায়। ১২ সেপ্টেম্বর আহমদ রফিকের ৯০ তম জন্মদিন পালিত হলো। ওই দিন প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারের শেষ অংশটা তুলে ধরি:
‘প্রথম আলো: পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের লেখনী দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ আমলে পারলেন না কেন?

আহমদ রফিক: প্রশ্নটি চমকপ্রদ। পাকিস্তান আমলে শ্রেণিস্বার্থের প্রয়োজনে সর্বমাত্রিক প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীরা এখন আয়েশে আরামে আছেন। তাই তাঁরা যুক্তিবাদী মুক্তবুদ্ধির সামাজিক আন্দোলনের ঝুঁকি কাঁধে নিতে চান না। এ ছাড়া স্বার্থহানিরও আশঙ্কা রয়েছে।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরে পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথিগুলো দিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। শেখ হাসিনার সম্পাদিত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড সম্প্রতি প্রকাশিত হলো। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শেখ মুজিবের কথা, কাজ, অবস্থান এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর খুলনার এক ছাত্রসভায় ২৮ বছর বয়সী শেখ মুজিব বলছেন, ‘দুঃখের বিষয় সব সভা সংগ্রামের নির্ভীক সৈনিক ছাত্র ও যুবকগণ আজ অন্যায়ভাবে ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন পুলিশ কর্মচারীগণ কর্তৃক নির্যাতিত হইতেছে। রাজশাহীর চারিজন ছাত্র কর্মীকে শহর হইতে বহিষ্কার করিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রত্যেক জিলায়ই কর্ম্মীদের উপর অন্যায়ভাবে জুলুম করা হইতেছে। এর তীব্র প্রতিবাদ করিবার জন্য সংঘবদ্ধ হউন। জননিরাপত্তার নামে বিনা বিচারে আটকের প্রতিবাদ করুন।’

কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য অতীতকে বিশ্লেষণ করো।’

এই কথা বহুল উচ্চারিত এবং এই কলামে আমি অনেকবার উদ্ধৃত করেছি, তা সত্ত্বেও আবারও উদ্ধৃতি দিচ্ছি-অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা বইয়ের ১৫৩ পৃষ্ঠা থেকে, ‘যে স্বাধীন দেশে নিয়মিত নির্বাচন হয়, যেখানে বিরোধী দল প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে সমর্থ, যেখানে সেন্সরশিপ ছাড়া সংবাদপত্রে রিপোর্ট ছাপা হতে পারে এবং সরকারি নীতির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, সেখানে দুর্ভিক্ষ ঘটে না।’

এটার সঙ্গে এই খবরটা মিলিয়ে পড়া যেতে পারে, ‘এখন ভোটের সময় ঘনিয়ে আসায় ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের মনে সংশয় ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে-এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ভোট দেবে তো? তাই ১৪-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের অনেকে শিক্ষার্থীদের মনের এই কষ্ট দ্রুত উপশমের ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ বোধ করছেন।’

‘আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা মনে করেন, শিক্ষার্থী ও তরুণেরাই ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন। এবারের নির্বাচনেও জয়-পরাজয় নির্ধারণে এঁদের ভোট বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।

‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। আর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ১৫ শতাংশের মতো; অর্থাৎ প্রতিটি আসনে গড়ে এই বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৫০ হাজারের কম-বেশি। এঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।

‘ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের হালনাগাদ শেষে নতুন ভোটারের সংখ্যা ৪৩ লাখের বেশি। সব মিলিয়ে এবার ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখের বেশি। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মতে, ৫০ হাজারের কম-বেশি ভোটার যেকোনো আসনের জয়-পরাজয় নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, বিষয়টি তাঁরা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে জানাবেন।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

অন্তত ভোট সামনে রেখে ভোটারদের চিত্তজয়ের জন্যও যদি ভালো কাজ করা হয়, তরুণদের মনের ক্ষত মোছার চেষ্টা করা হয়, সে-ও ভালো। ভালো কাজ দেরিতে হলেও ভালো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ১২ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সদ্য প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টস বই থেকে তার কিছুটা উদ্ধৃত করি।

শেখ মুজিব বলছেন, ‘গণ-জীবনে আজাদীর পরিবেশ সৃষ্টি না করিয়া আজাদী উৎসব করিতে যাওয়া এবং বন্যাক্লিষ্ট, দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মরণোন্মুখ জনগণকে সেই উৎসবের শরীক হইতে বলা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রহসনে আত্মপ্রতারিত নেতারাই সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন, জনগণ-বিশেষ করিয়া সচেতন ছাত্র ও যুব-সমাজ উহা দ্বারা বিভ্রান্ত হইবে না। তারা “আজাদী দিবস” অবশ্যই পালন করিবে, কিন্তু সেটা উৎসবের দিন হিসাবে নয়, উৎপীড়নের নিগড় ছিন্ন করার সংকল্প নেওয়ার দিবস হিসাবে পালন করিবে।’

সম্প্রতি নানান খবরে দেখছি, সরকার গুজব নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। গুজব শনাক্ত করে তা দূর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই জরুরি একটা বিষয়। গুজব খুব ক্ষতিকর। অনলাইন যেন গুজবের কারখানা হয়ে গেছে। সত্য-মিথ্যা আলাদা করা যাচ্ছে না। গুজব রোধ করার বা গুজবের ক্ষতি কমানোর জন্য এক নম্বর করণীয় কর্তব্যটা আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের জানা আছে। তা হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। পেশাদার স্বাধীন সাংবাদিকতাই পারে গুজবের ক্ষতি রোধ করতে। ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করলে, পেশাদার সংবাদমাধ্যমের কাজকে কঠিন করে তুললে গুজব প্রাধান্য পাবে।

বাদশা বীরবলকে বললেন বোকা লোক ধরে আনতে। বীরবল একজনকে ধরে আনল। লোকটা ঘরের অন্ধকার দূর করতে আলো নিয়ে যেতে চাইছিল নিজের ঘরে। সে জন্য সে আলোকস্তম্ভের নিচে এসে জাল ফেলে আলো ধরার চেষ্টা করছিল।

ছড়ি ঘুরিয়ে, তরবারি চালিয়ে অন্ধকার দূর করা যায় না। আলো জ্বালাতে হয়। জাল দিয়ে আলো ধরা যায় না। পেশাদার স্বাধীন সাংবাদিকতার আলোই পারে গুজবের আঁধার দূর করতে।

তেমনি জুলুম-নিপীড়নের বদলে আজাদীর পরিবেশ পারে জনগণ তথা ভোটারদের চিত্ত জয় করতে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক