গন্ডার পার্টি (কানাডা) ও বোবা পার্টি (বাংলাদেশ) সমাচার

কানাডায় ‘গন্ডার পার্টি’ বা রাইনোসেরস পার্টি অব কানাডা নামে একটি রাজনৈতিক দল আছে। এই দলের স্লোগান: ‘আমাদের একটিই প্রতিশ্রুতি—নির্বাচিত হলে কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখা হবে না’। (আ প্রোমিজ টু কিপ নান অব আওয়ার প্রোমিজেস)। দলটির প্রধান বলেন, তাঁরা ‘মার্ক্সিস্ট-লেননিস্ট’। না, কার্ল মার্ক্স বা লেনিন নন, গ্রাউচো মার্ক্স নামের আমেরিকার শ্রেষ্ঠ চৌকস কমেডিয়ান এবং মার্কিন গায়ক জন লেননের আদর্শে অনুপ্রাণিত দল। ভণ্ডদের রাজনীতিকে গ্রাউচো মার্ক্সের মতো হুল ফোটানো সমালোচনা এবং পরিবর্তনের জন্য জন লেননের মতো গেয়ে চলাই বরং উত্তম রাজনৈতিক দর্শন। এ জন্য দলটি মার্ক্সবাদী (গ্রাউচোবাদী) ও লেননবাদী (মার্ক্সিস্ট-লেননিস্ট)।

১৯৬৩ সালে জন্ম নিয়ে ১৯৯৩ পর্যন্ত, আবার ২০০৬ সালে পুনর্জন্ম নিয়ে ২০১০ পর্যন্ত বেশ টিকেই ছিল দলটি। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ১২০টি আসনে দলের প্রার্থী পর্যন্ত দিয়েছিল। ১ লাখ ১০ হাজার ভোটও পেয়েছিল। কানাডার ভোটার সংখ্যা বিচারে ১ লাখ ১০ হাজার অনেক বড় একটি সংখ্যা। সর্বশেষ নির্বাচন ২০১৫-তেও দলটি কয়েকটি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। দলটির মূলনীতির কিছু নমুনা এ রকম:

—যারাই লটারি বা লোটোর জ্যাকপট জিতবে, তাদের টাকা দেওয়ার বদলে সিনেটর বানানো হবে। (বলা বাহুল্য, কানাডীয়রা খুব বেশি লটারি টিকিট কেনে)।
—অ্যান্টার্কটিকাকে ঠেলে আর্কটিকের সঙ্গে এক করে দেওয়া হবে। তাতে সারা পৃথিবীর শীতের ওপর কানাডার একক বিশ্ব শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
—ব্রিটেনের রানি যেহেতু কানাডার রানি, তাঁকে ক্যুইব্যকের বাকিংহামে রাখা হবে।
—ব্রিটেনকে কানাডার ১১তম প্রদেশ ঘোষণা করা হবে। (১৯৭৯ সালের ঘোষণা, যে সময় কানাডায় ১০টি প্রদেশ ছিল)।

১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ‘দ্য ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকা অ্যাক্ট ১৮৬৭’-র বলে কানাডার সংবিধান সংশোধন করতে পারত। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টির পিয়েরে ট্রুডোর প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি নির্বাচিত হলে পুরোপুরি স্বদেশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবেন এবং এই আইন রদ করাবেন। গন্ডার পার্টি ঘোষণা দেয়, ‘আমরা নির্বাচিত হলে পুরো ব্রিটেনকেই ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসব এবং ১১তম প্রদেশ বানাব।’ সুতরাং আমাদের ভোট দাও।

দলটির প্রতিশ্রুতি ‘নির্বাচিত হলে কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখা হবে না’ বলার সরাসরি যুক্তি আছে। রাজনীতিকেরা স্বভাবতই মিথ্যুক। ভোটের সময় গাদা গাদা প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচিত হওয়ার পর কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সজ্ঞানে তা ভুলে যান। ‘প্রতিশ্রুতি রাখছ না কেন?’—প্রশ্ন করে জনগণ যতই খোঁচাক না কেন, তাঁরা তখন স্পিকটি-নট গন্ডার হয়ে থাকেন। তার চেয়ে প্রথম দিনই গন্ডারকে তথা রাইনোসেরস পার্টি অব কানাডাকে ভোট দাও। ‘না ভোট’ আন্দোলন জনপ্রিয় হওয়ার পেছনেও গন্ডার পার্টির ভূমিকা আছে।

বোঝাই যাচ্ছে, এটি একটি প্যারোডি পলিটিক্যাল পার্টি। যেমন: পার্টির প্রতিশ্রুতির মধ্যে আরও ছিল:

—কোনো আইন যদি রদই করতে হয়, তবে বিজ্ঞানী নিউটনের ‘ল অব গ্র্যাভিটি’ই (অভিকর্ষ সূত্র) রদ করা হবে।
—উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য খুবই লম্বা লম্বা সুউচ্চ স্কুলঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে।
—কানাডার শিক্ষার মাধ্যম হবে তিনটি: ইংরেজি, ফরাসি ও নিরক্ষরতা।
—কানাডার ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ তকমা বদলে ‘স্নো স্ট্যান্ডার্ড’ তকমা দেওয়া হবে।
—অস্ত্র ও মাখন (গান অ্যান্ড বাটার) দুটোই নিষিদ্ধ করা হবে, কারণ দুটোই জীবনহানিকর।
—রকি পর্বতমালাকে আলগা করে ফেলা হবে, যাতে আলবার্টার অধিবাসীরা প্রশান্ত মহাসাগরের সূর্যাস্ত দেখতে পারে।
—বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য ‘স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’কে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। কারণ, ‘স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’ নামের আমলাতন্ত্রের কোনো কাজকর্ম নেই, প্রতিবছর খালি বেকারত্বের হার নির্ণয় নিয়ে থাকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, গন্ডার পার্টি কি শুধুই বিনোদন, রসিকতা, মজামাস্তি, ফাজলামি বা ঠাট্টা-মশকরা করার পার্টি ছিল (কাগজে-কলমে এখনো আছে)?

না! পার্টিটির ডার্ক পলিটিক্যাল স্যাটায়ারগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্র কশাঘাতের মাধ্যমে রাজনীতিকদের শঠতা, মিথ্যাবাদিতা ও ভণ্ডামিগুলোর বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা। কাজটি বৈধভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করার সুচিন্তা থেকেই বিধিবদ্ধ ও তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক দলের অনুমোদন নেয় গন্ডার পার্টি। এই নিয়মসিদ্ধতার কারণে জনগণের কাছে রাজনীতিবিষয়ক সচেতনতামূলক বার্তাগুলোও পৌঁছে দেওয়া গিয়েছিল অত্যন্ত সহজে। কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-শিল্পীরা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা যতটা না কানাডীয়দের রাজনীতি-সচেতন করতে পেয়েছিল, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি করতে পেরেছিল এই দল। দলের পলিটিক্যাল স্যাটায়ারগুলোর ব্যাপক জনমুখীনতা যেমন ছিল, কার্যকারিতাও ছিল অসাধারণ রকমের।

উল্লেখ্য, ‘ইলেকশন কানাডা’ (নির্বাচন কমিশন) বরাবরই পার্টিটিকে লিবারেল বা কনজারভেটিভদের সমতুল্য জ্ঞান করেছে। কোনোভাবেই কোনো অধিকার প্রদানে তারতম্য বা হেরফের করেনি। ২০০৬ সালে নতুন কিছু মুখ যখন পার্টির নিবন্ধন নবায়নের জন্য আবেদন করে, কিছু পত্রপত্রিকা সামান্য গাঁইগুঁই করে বলছিল, ‘ইলেকশন কানাডা’ নিবন্ধন দেওয়ার আগে আরেকটু ভেবে দেখবে কি না। ‘ইলেকশন কানাডা’র অবস্থান ছিল এ রকম: গণতন্ত্রের জন্য, দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য, অসংগতি ও অসংগত রজনীতি প্রতিরোধের জন্য জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে তো গণতন্ত্রের ভিত্তিই শক্তিশালী হবে। রাজনীতি নাগরিকের অধিকার। স্যাটায়ারও নাগরিকের অধিকারের অংশ।

কানাডার গণতন্ত্র বস্তুত পৃথিবীর সেরা গণতন্ত্রের একটি। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদে সিংহভাগ রাজনীতিকই অসাধারণ ভালো মানুষ। তাদের জনমুখীনতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সততা, স্বচ্ছতা ও মানবিকতার গল্প কুকর্মের গল্পের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তা-ও তাঁদের আচরণ ও দায়িত্বের বেলায় নুন থেকে চুন খসলে কমেডিয়ানরাসহ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আমলা, নাটক-সিনেমার লোকজন তুলোধোনা করতে ছাড়ে না। ‘রাইনোসেরস পার্টি অব কানাডা’র রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন দেশটির গণতন্ত্র চর্চার বাস্তব উদাহরণ।

এই অধম লেখকের উদ্দেশ্য কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা মোটেই নয়। উদ্দেশ্য শুধু এটিই বলা যে পৃথিবীর যেকোনো গণতন্ত্রেরই অত্যাবশ্যকীয় শর্ত, রাজনীতিকদের আচরণ ও দায়িত্বে বিচ্যুতি ধরা পড়লে কমেডিয়ানরাসহ শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আমলা, নাটক-সিনেমার লোকজন তুলোধোনা করে তাঁদের লাইনে নিয়ে আসবেন।

বাংলাদেশে রাজনীতি একটি মৃত ঘোড়া এবং গণতন্ত্র মৃতপ্রায়। বিরোধী দলের রাজনীতি বা রাজনীতির অধিকার ‘কাজির গরু কাগজে আছে গোয়ালে নেই’ অবস্থা। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়, আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলোয়ও অবশ্য বাংলাদেশকে আর ‘ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি’ ধরা হয় না। বলা হয় অ্যানোক্রেসির উদাহরণ, বা ‘অ্যানোক্রেটিক কান্ট্রি’ বা ‘গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘আধা গণতন্ত্র আধা স্বৈরতন্ত্র’। কারণ, আগে বাংলাদেশের শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকেরা সরকারি দল সমর্থক হয়েও রাজনীতির ও রাজনীতিকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি-গলদগুলো ধরিয়ে দেওয়ার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব ও দায়বোধের প্রকাশ ঘটাতেন; তাঁদের করণীয়গুলো কমবেশি করার চেষ্টা করতেন। এখন যেহেতু অবস্থা অন্য রকম—তাঁরাই স্টাবলিশমেন্টের মূল খুঁটি ও সুবিধাভোগী—তাঁরা মূলত এবং জ্ঞানত বোবা-কানা-বধির। এই বাস্তবতাটি জেনে প্রায়ই ভাবি, আহা, বাংলাদেশে যদি অন্তত একটি ‘রাইনোসেরস পার্টি অব বাংলাদেশ’ থাকত। তারা সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কিছুই বলতে পারত না নিশ্চিত, তবে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসদের বিচ্যুতি নিয়ে অন্তত কিছু স্যাটায়ার করতে পারত, যা আসলে রাজনীতি বা রাজনীতিকদের নিয়ে স্যটায়ারের চেয়েও বেশি জরুরি এই বিচিত্র সময়টিতে। সেটা নেই, তবে যে নীরবতা দেখা যায়, তাতে মনে হয় বোবা পার্টিই সফল হবে বাংলাদেশে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।