কট্টরবাদীদের উত্থান থামল

ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো, বিশেষত সুইডেনের রাজনীতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য গণতন্ত্র ও উদারনীতি। কিন্তু নির্বাচনের আগে চাউর ছিল সুইডেনের উদারবাদী রাজনীতিকেও এবার অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর কট্টরবাদী রাজনীতি গ্রাস করবে। তবে শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। কিন্তু পতন ঘটেছে সুইডেনের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট আর পরিবেশবাদী সবুজ দলের জোট সরকারের। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা এবার কম আসন পেলেও সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর অভিবাসীবিরোধী কট্টরপন্থী সুইডেন ডেমোক্রেটস পার্টি ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রক্ষণশীল মডারেট দল। সুইডেন অর্থনীতিতে সবল, জনকল্যাণ রাষ্ট্র এবং উদারপন্থী রাজনীতি ও অভিবাসীবান্ধব দেশ। 

সুইডেনে এবারের নির্বাচনে সফল ব্যক্তি হলেন বর্ণবাদী সুইডেন ডেমোক্রেট দলের ৩৯ বছর বয়সী নেতা জিমি অ্যাকসন। তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের কট্টরবাদী নেতাদের মতো উগ্র নন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, বক্তৃতা করেন বুদ্ধিজীবীসুলভ। ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সুইডিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিজের দলকে তৃতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত করেছেন। তাঁর সাফল্যের কারণ শরণার্থী-অভিবাসীবিরোধী অবস্থান ও পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা। ভেবেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর দল দ্বিতীয় হবে, কিন্তু তা হয়নি।
১৯৮৮ সালের দিকে ‘সুইডিশদের জন্য সুইডেন’ স্লোগান তুলে ‘সুইডেন পার্টি’ নাম দিয়ে দলটি গঠিত হয়। অধিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য পরে নাম বদলে করা হয় ‘সুইডেন ডেমোক্রেটস পার্টি’, প্রতীকও বদলানো হয়। দলটির শুরু থেকেই মূল সমর্থক অতি জাতীয়তাবাদী সুইডিশরা। ১৯৯৫ সালের দিক থেকে দলটি নতুন আদলে গড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। মধ্য বা দক্ষিণ ইউরোপীয় ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কট্টরবাদী দক্ষিণপন্থী দলগুলোর মতো ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ, অভিবাসন, শরণার্থী ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে এবারের জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে।
এর আগের নির্বাচনগুলোতে এই বর্ণবাদী দল এতটা সাফল্য পায়নি। ২০১০ সালের নির্বাচনে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সুইডিশ পার্লামেন্টে ৪৯ আসন নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তর দল হলেও পার্লামেন্টে তারা সব সময় অন্য দলগুলোর অসহযোগিতার কারণে একঘরে হয়ে থেকেছে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টেও তাদের ২০ আসন রয়েছে এবং তারা ইইউ পার্লামেন্টে রক্ষণশীল জোটের সদস্য।
ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রেট দল বরাবরের মতো ২০১৫ সালেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য সুইডেনের সীমান্ত খুলে রেখেছিল। সুইডেনে শরণার্থীদের গ্রহণ ও দক্ষিণের কিছু শহরে অপরাধী কিছু অভিবাসীর কারণে কট্টরবাদী ও দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ঢালাও সমালোচনার মুখে এই দলের জনপ্রিয়তা বেশ কমে যায়। শরণার্থীরা আসার ফলে জনকল্যাণমূলক সেবা, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা চাপের মধ্যে পড়বে বলে প্রচার চালানো হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে দেশটি বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। পরবর্তী সময় ক্ষমতাসীন জোট সরকার শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত বন্ধসহ আরও কিছু নতুন সিদ্ধান্তের কারণে দলটি চার বছর আগের তুলনায় কম ভোট পেলেও এবারও তারা সুইডিশ সংসদের বড় দল। তবে সুইডেনের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এই সামাজিক গণতন্ত্রী দল এককভাবে বা বিগত চার বছরের জোটের সঙ্গী সবুজ দল নির্বাচনে খারাপ করায় তাদের সঙ্গে জোট বাঁধা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে সরকার চালানোর জন্য নতুন জোটসঙ্গী খুঁজতে হবে। তারা সমমনা শিবির নিয়ে জোট বাঁধতে পারে বা সংখ্যালঘু সরকার গঠনের ঝুঁকিও নিতে পারে। অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দল রক্ষণশীল মডারেটররা তাদের সমমনাদের নিয়ে জোট গঠন করতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে কথা ছিল, সুইডেনের কোনো দলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বর্ণবাদী সুইডিশ ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গে আঁতাত করবে না।
প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফভেনের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল ও গ্রিন পার্টির জোটের প্রতি সমর্থন রয়েছে বাম দলগুলোর। অন্যদিকে চারটি দল নিয়ে গঠিত হয়েছে ডানপন্থী জোট। এই জোটের হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে আছেন উলফ ক্রিসটেরসন। সুইডেনের প্রতিবেশী ডেনমার্ক ও নরওয়েতে ক্ষমতায় আছেন বর্ণবাদী রক্ষণশীলেরা।
উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানী সুইডেনের জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত উলফ পালমের ছেলে ইয়োকিম পালমে জার্মানির স্পিগেল পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৈন্যের কারণে সুইডেনের শক্তিশালী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে। নতুন সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় পুরোনো রীতি ভেঙে না বেরিয়ে আসতে পারলে সরকার গঠন আরও জটিল হবে। শেষ পর্যন্ত সুইডেনে কোন জোট সরকার গঠন করবে, তা দেখতে আগামী পার্লামেন্ট অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি
sharaf. ahmed@gmx. net