'দেশ কোন দিকে যাচ্ছে?'

হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাসে-লঞ্চে-ফুটপাতে, পথ চলতে চলতে দেখা হয় অনেকের সঙ্গে। স্লামালেকুম, কেমন আছেন—এ রকম শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সবাই প্রশ্ন ছুড়ে দেন—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? দেশের অবস্থা কী? এসব প্রশ্নের চটজলদি জবাব দেওয়া যায় না। সবজান্তার মতো ভাব করে বলতে হয়—সব ঠিক আছে, অথবা আমরা জাহান্নামে যাচ্ছি, অথবা নির্বোধের মতো বলতে হয়—কিছুই বুঝতে পারছি না।

মানুষের মনে কৌতূহল, চোখে জিজ্ঞাসা। এর একটি ইতিবাচক দিক আছে। সবাই দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে ভাবেন। দেশের মঙ্গল হলে খুশি হন, খারাপ সংবাদ পেলে কষ্ট পান। আবার এর একটি নেতিবাচক দিকও আছে। কেমন যেন একটা সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার দিকে আমরা দ্রুত ধাবমান হচ্ছি। আমরা কি আস্থা হারিয়ে ফেলছি?

শুনতে পাই ডিসেম্বরের শেষে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তারিখ ঘোষণা করেনি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কথা বলেছেন কমিশনের সচিব। তিনি সরকারের লোক। হয়তো সরকারের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, নির্বাচন ২৭ ডিসেম্বর হবে, এটা তাঁর ‘হাঞ্চ’ বা অনুমান। এ নিয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী তাঁর মৃদু সমালোচনা করেছেন। এটা শুনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

এক অর্থে বলা যায়, নির্বাচন হতে যাচ্ছে ১০ বছর পর। ৫ বছর আগে একটি নির্বাচন হলেও তাতে ভোটারদের অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। ১৫৩টি নির্বাচনী আসনে ভোট হয়নি। বিএনপির নেতৃত্বে একটি জোট ভোট বর্জন করেছিল। তাদের সঙ্গী হয়েছিল আরও কয়েকটি দল। সেসব আসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থীরা বিনা বাধায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ দেশে সচরাচর অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচনে দাঁড়াতে দেখা যায়। কিন্তু ১৫৩টি আসনে মহাজোটের প্রার্থীরা এতই জনপ্রিয় যে আর কেউ সেখানে দাঁড়ানোর সাহস দেখাননি। বাকি আসনগুলোর ভোট হওয়ার আগেই সরকার গঠন করার মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। তাই অন্য আসনগুলোতে ভোট হলেও ভোটারদের মধ্যে তেমন উৎসাহ ছিল না। নির্বাচন কমিশন অবশ্য দাবি করেছিল, শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে। অনেকেই এই দাবির সত্যতা খুঁজে পাননি। কমিশনের দাবি মেনে নিলেও এটা স্বীকার করতেই হয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা ভোট দেননি।

এবার যখন নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে উঠেছে, সবাই অস্থির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, তাঁরা ভোট দেবেন। অনেক তরুণ-তরুণী প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। স্বভাবতই তাঁদের আগ্রহ ও উৎসাহ বেশি থাকার কথা। এ দেশে এতবার নির্বাচন হওয়ার পরও নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস গেল না। ভোটারদের সামনে দুটো প্রশ্ন: এক. নির্ঝঞ্ঝাটে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কি না; দুই. তাঁর ভোটটি ঠিকমতো গোনা হবে কি না। এ দেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া, তার বয়স প্রায় শত বছর। কিন্তু এখনো উদ্বেগ গেল না। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্রের জন্য এ দেশ, এ দেশের মানুষ যথেষ্ট তৈরি কি না।

নির্বাচন সামনে রেখে পরস্পরবিরোধী রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তাদের বাক্যবাণ, আস্ফালন এবং তর্জন-গর্জনে পরিবেশ ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। আগামী নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণভাবে হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। নির্বাচন ভালো হওয়া বা না হওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে বিবদমান প্রার্থী ও দলের আচরণের ওপর। তারা চাইলেই একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হবে। অতীতের নির্বাচনগুলোয় আমরা অনেক মারামারি-কাটাকাটি-খুনোখুনি দেখেছি। এবারও কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো বলেই দিয়েছেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না—এই গ্যারান্টি তিনি দিতে পারেন না। এটা তাঁর অক্ষমতার আহাজারি কিংবা বাস্তবতার স্থূল প্রতিফলন।

আমরা শুনেছি, অনেক বছর আগে এ দেশে  নাকি ভালো, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন হতো। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনটি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অতি উৎসাহী হয়ে আমরা অনেকেই একটার বেশি ভোট দিয়েছিলাম। না দিলেও ফলাফলে হেরফের হতো না। নির্বাচনটি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়েছিল। ওটাকেই এখন পর্যন্ত একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো সে রকম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

আমার মনে একটা কৌতূহল, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনটি কেমন ছিল। শুনেছি, ওটাই নাকি ভালো নির্বাচন ছিল, যেমনটি আমরা দেখেছি ১৯৭০ সালে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছিলেন এবং ভোট দিয়েছিলেন, ওই প্রজন্মটি এখন বিলীয়মান। প্রবীণদের স্মৃতিতে হয়তো এখনো তা রয়ে গেছে। ওই নির্বাচন সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া যায়।

চুয়ান্নর নির্বাচন হয়েছিল ৮ থেকে ১২ মার্চ। ওই নির্বাচনে শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানী ও সোহ্‌রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করেছিল। তখন ছিল ‘পৃথক নির্বাচনী’ ব্যবস্থা; অর্থাৎ মুসলমান আসনে ভোট দিত মুসলমানরা, অমুসলমানরা দিত অমুসলমান প্রার্থীকে। তো, ২৩৭টি মুসলমান আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল ২২৮টি আসনে। নির্বাচনটি কেমন হয়েছিল? তার আগে পরিস্থিতি কেমন ছিল? কোথাও কি কোনো রকম গোলমাল হয়নি? এর তত্ত্বতালাশ করতে খোঁজ নিলাম তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির। ১৯৫৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে:

‘সকাল সাতটায় রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে পৌঁছালাম। হাতিরদিয়া ও আড়াল থেকে শাহজাহানের নেতৃত্বে একদল কর্মী স্টেশনে এল। মাওলানা ভাসানী সাহেবকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পাঁচ শতাধিক মানুষ অপেক্ষা করছিল।...সেখান থেকে হাতিতে করে কাপাসিয়ায় রওনা হলাম। পাঁচ শর মতো মানুষ সঙ্গে চলল। রাজবাড়ি ও কাপাসিয়ার মাঝপথে মুসলিম লীগের ৬০ জনের মতো গুন্ডা হঠাৎ লাঠি, বাঁশের তীক্ষ্ণ বল্লম এবং ইটপাটকেল ছুড়ে আমাদের ওপর প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করল। ইটের টুকরোর আঘাতে আমাদের ১২ জনের মতো আহত হলো। আমরা সবাই ছিলাম খালি হাতে। তারা হাতিকে ভয় দেখানোর জন্য জেলা বোর্ডের রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজন এবং কাপাসিয়া থেকে আসা লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলে গুন্ডারা উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যায়।...প্রায় ৫ হাজার লোক আমাদের কাপাসিয়াতে নিয়ে গেল। অবাক কাণ্ড যে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর, একদল কনস্টেবল, তিনজন সাব-ইন্সপেক্টর কাছেই ঘুরছিল। কিন্তু তারা একেবারেই নিশ্চুপ ছিল।

‘মাওলানা ভাসানী ঈদগাহ ময়দানের জনসভায় বক্তৃতা করলেন। তিনি ডা. গিয়াসুদ্দিনের বাড়িতে আরজু মিঞার নিয়ে আসা খাবার খেলেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে হাতির পিঠে চড়ে আড়াল পৌঁছালাম।...আড়ালের জনসভায় ৮০ হাজারের মতো লোক উপস্থিত ছিল। জহির ভাই ঢাকা থেকে এসেছেন।

‘রশিদ মিঞা রাত ১১টার দিকে ভাসানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন। রাত দেড়টায় ঘুমাতে গেলাম (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, ১৯৫৪, প্রথমা প্রকাশন)।’

ভাবতে অবাক লাগে। নির্বাচনী প্রচারে তখনো প্রতিপক্ষের গুন্ডারা হামলা করত। তখনো পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করত। তবে জনতা ধাওয়া করলে গুন্ডারা পালাত।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক