বেঁচে গেল শতবর্ষী বৃক্ষরাজি

‘শত শত মুখ হায় একাত্তর, যশোর রোড যে কত কথা বলে/এত মরা মুখ আধমরা পায়ে, পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে/সময় চলেছে রাজপথ ধরে, যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল/সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল’—মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ শিরোনামের এই কবিতা লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাস্তুহারা লাখ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থী যশোর রোড ধরে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। এই কবিতায় সেই মর্মন্তুদ দৃশ্যের ছবি এঁকেছিলেন গিন্সবার্গ।

যশোর রোডের সেই দৃশ্যকল্প যার চোখে ভাসবে, তার কল্পনার সেই দৃশ্যে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গাছও থাকবে। এই প্রাচীন বৃক্ষগুলো যশোর রোডের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শরণার্থীরা রাস্তার দুই ধারের এসব গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা গাছগুলো আমাদের আবেগের সঙ্গে মিশে আছে। এই বৃক্ষরাজি কেটে সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু লাখো মানুষের দাবির মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।

সওজ ও জেলা পরিষদের হিসাব বলছে, যশোর রোড হিসেবে পরিচিত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কটির উভয় পাশে রেইনট্রি, মেহগনি, বাবলা, খয়ের, কড়ই, আকাশমণি, বট, শিশু, ঝাউ, আম, কাঁঠাল, সেগুন, শিমুল ও দেবদারু মিলিয়ে মোট গাছ রয়েছে ২ হাজার ৩১২টি। এর মধ্যে ১০০ বছরের বেশি পুরোনো রেইনট্রি রয়েছে ৭৪৫টি। এলাকাবাসী, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির প্রতি একাত্ম হয়ে গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসেছে। গাছগুলো না কেটেই সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু হবে। শেষ হবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সুচিন্তিত ও বিবেচনাপ্রসূত বলেই আমরা মনে করি। কারণ, মহাসড়কটির শতবর্ষী গাছগুলো স্বাধীনতাসংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত। আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই। তবে সেটা ঐতিহ্য ও পরিবেশকে রক্ষা করে। সরকার সেটা মেনে নিয়েছে। সওজ যশোর কার্যালয় বলছে, গাছ না কাটায় কোথাও কোথাও মহাসড়কটির প্রশস্ততা ৫-৬ ফুট কমবে। সব দিক থেকে বিবেচনা করলে এটুকু অসুবিধা মেনে নেওয়াই যথার্থ হবে।

ইতিহাস বলছে, প্রায় ২০০ বছর আগে যশোর অঞ্চলে কালী প্রসন্ন রায় নামে এক জমিদার ছিলেন। ১৮৪০ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। তঁার ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার শ্রমিক দিন-রাত কাজ করে ১৮৪২ সালে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করেন। সেই পথেই পরবর্তী সময়ে এসব গাছ লাগানো হয়।

গাছ না কেটে সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে শুধু উন্নয়নের ছবি থাকবে না, এর পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শতবর্ষী গাছগুলোও দাঁড়িয়ে থাকবে। এটি ঐতিহ্য ও উন্নয়নের মেলবন্ধন হিসেবে আমাদের সামনে দৃশ্যমান থাকবে।