শীর্ষ ঋণখেলাপি

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কথা রেখেছেন। তিনি গত বুধবার জাতীয় সংসদে শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে, তাঁর প্রকাশিত তালিকার বাইরেও অনেক ঋণখেলাপি আছেন, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা হিসাবের কারসাজিতে নিজেদের নাম আড়াল করতে সক্ষম হয়েছেন; যাঁদের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকেরাও রয়েছেন।

ব্যাংকঋণের বিষয়টি পুরোপুরি ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় হলেও এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, যেসব বড় খেলাপির নাম প্রকাশ করা হয়নি, তা যত না আইনি জটিলতা, তার থেকে রাজনৈতিক সমস্যা বেশি।  

শীর্ষ ঋণখেলাপি হিসেবে যাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, তাঁদের লজ্জা হবে কি না কিংবা তাঁদের কাছে পাওনা অর্থ অদূর ভবিষ্যতে ফেরত পাওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দিতে পারে। ১০০ শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ব্যবসার সূত্রে রাজনীতিক বনে যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। যখন রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সেই ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে কোনো পরিচালক খেলাপি হন, তখন সেটি আইনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ। কৌতূহলের বিষয় যে এই রাজনীতিক বনে যাওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেমন আওয়ামী লীগের সাংসদ আছেন, তেমনি আছেন সাবেক মন্ত্রী এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারাও। এঁরা যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন এবং পরিশোধে অনাগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঋণখেলাপির সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ এবং এঁদের কাছে আটকা আছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের নানাভাবে প্রণোদনা দেওয়া, অন্যদিকে তাঁদের ঋণখেলাপি হওয়া ব্যাংকিং খাতের অসুস্থতারই লক্ষণ।

অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, খেলাপি ঋণের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের সংখ্যা ৮৮ এবং  সিংহভাগ খেলাপি ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ সোনালী ব্যাংকের, ১৮ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এরপর যথাক্রমে জনতা ব্যাংকে ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৯ হাজার ২৮৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৪ হাজার ৯০১ কোটি, বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৭৬ কোটি, কৃষি ব্যাংকে ২ হাজার ১৭৮ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ২ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে পূবালী ব্যাংকে ২ হাজার ১১৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ৫ হাজার ৭৬ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ৩ হাজার ৫২০ কোটি আর প্রাইম ব্যাংকে ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে।

খেলাপি ঋণের সমস্যাটি বেশ পুরোনো এবং পূর্বাপর সব সরকার একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও ঋণখেলাপিদের কাছে প্রাপ্য অর্থ উদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।  

আরও উদ্বেগের বিষয়, যে সরকার খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, সে সরকারের দুজন সাংসদের কোম্পানিও শীর্ষ খেলাপি ঋণের তালিকায় আছে। এগুলো হলো যথাক্রমে ঢাকার সাংসদ আসলামুল হকের নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি ও রাজশাহীর সাংসদ এনামুল হকের নর্দান পাওয়ার সল্যুশন। যাঁদের দায়িত্ব খেলাপি ঋণ আদায়ে আইন করা, তাঁরাই যদি খেলাপি ঋণে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরে আসবে কীভাবে?  

সংসদে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করলেই অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। তাঁর সময়েই হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংকের মতো ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে।  ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে খেলাপি ঋণ আদায় করার বিকল্প নেই।