বগুড়া ও নারায়ণগঞ্জ: দায়িত্ব কার, হচ্ছেটা কী?

আবারও আলোচনায় বগুড়া। সঙ্গে নারায়ণগঞ্জও। গেল সপ্তাহের দুটি ঘটনা সামাজিক ও গণমাধ্যমে সাড়া তুলেছে। একটি হচ্ছে বগুড়ায় বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকে ৪০ জন কিশোর-কিশোরী আটকের ঘটনা। আরেকটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে গুলিবিদ্ধ তিনজনের লাশ উদ্ধার। মনে হতে পারে এই দুই ঘটনার সম্পর্ক নেই। এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আছে আবার নেই। নেই এই অর্থে যে দুটি পৃথক জেলার একেবারেই ভিন্ন ধরনের দুটি ঘটনা। আর সম্পর্ক আছে বলতে বোঝানো যায় যে দুটি ঘটনাতেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বের বিষয়টি চলে আসে। দুটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালন ও প্রশাসনের নৈতিকতার প্রশ্ন সামনে এসে যায়।

প্রথমেই বগুড়ার প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। সেখানে রীতিমতো তালেবানি কায়দায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিশোর-কিশোরীদের আটক করেছে। তাদের পুলিশের গাড়িতে করে আনা হয়েছে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। সাংবাদিকেরা তাদের ছবি তুলেছে। তাদের অভিভাবকদের ডেকে আনা হয়েছে। বগুড়ায় তো বটেই, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে হরহামেশা এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। যা হোক, পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায়। এসব ছবি আমরা অনেকেই দেখেছি। এতে করে ওই কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে। এদের কেউ কেউ মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

খেয়াল করা দরকার, গত মাসেই দেশের কিশোর-কিশোরীরা একসঙ্গে রাস্তায় নেমে পাশাপাশি থেকে সড়কে নিরাপত্তার আন্দোলন করেছে। সেখানে তারা ছিল পরস্পরের ভরসাস্থল।

কিশোর-কিশোরীদের বাড়ির বাইরে একসঙ্গে বসে গল্প করা, মেলামেশার বিষয়টি তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা যায়। সামাজিক, আইনগত ও ধর্মীয়। সামাজিকভাবে কিশোর-কিশোরীদের বন্ধুত্ব বা মেলামেশায় কোনো বিধিনিষেধ বাংলাদেশের সমাজে আছে বলে আমার জানা নেই। সাধারণত, পারিবারিকভাবে এসবের ওপর নজর রাখা হয়, যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়। পারিবারিকভাবে শুধু কিশোর-কিশোরী না, কিশোর-কিশোর বা কিশোরী-কিশোরীদের মেলামেশাতেও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এর সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না, ওর সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাবে না। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় শ্রেণিগত মনস্তত্ত্ব কাজ করে। তবে এটা সমাজে খুবই কম ঘটে থাকে। আমরা সমাজের ৯৯ শতাংশই বিভিন্ন শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ ও ধর্মের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে বড় হয়েছি।

আমি জানি না বাংলাদেশের কোনো আইনে কিশোর-কিশোরীদের কোথাও বসে গল্প করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে কি না। এটা যদি আইনগতভাবে কোনো ‘অপরাধ’ হয়ে থাকে, তবে একুশ শতকের বাংলাদেশের নাগরিকেরা সেই আইন নিয়ে ভাবতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিশোর-কিশোরীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হলো কীভাবে? কারা এই ছবি সরবরাহ করল? কে কাকে দিল? গণমাধ্যমসূত্রে যতটুকু জেনেছি, এই অভিযান সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীদের কিছু জানানো হয়নি বা প্রশাসনের নিজস্ব ও একান্ত বিশ্বস্তদের জানানো হয়েছে। হয়তো এরাই ছবি প্রকাশ করেছে বা প্রশাসন নিজেই করেছে। প্রশাসন যদি করে থাকে, তবে তা কতটা নৈতিক? যদিও বগুড়ার জেলা প্রশাসক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কিশোর-কিশোরীদের অবাধ মেলামেশার পক্ষে বলছি না। কিন্তু নৈতিকতা ও বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও আলাপ-আলোচনা সম্ভব। সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজ গঠনে সব বয়সীদেরই মেলামেশার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে অবদমনের মধ্য দিয়ে একধরনের অস্বাভাবিক, অসুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের বড় বড় শহরে খেলার মাঠ নেই, পার্ক নেই। উঠতি বয়সীরা নিশ্চয়ই সারা দিন টিভি সেট বা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকবে না। যখন স্বাভাবিক মেলামেশার সুযোগগুলো সংকুচিত হয়ে আসবে, হয়রানি করা হবে, তখনই সমাজে অস্বাভাবিক আচরণ বেড়ে যাবে। এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া উচিত।

সামাজিক, আইনগত ও ধর্মীয় ধারণাগুলো আমলে নিয়ে বলা যায়, বগুড়ার প্রশাসন উদ্ভট ও হঠকারী কাজ করেছে। এর আগেও বগুড়ায় এমনটি হয়েছিল। এক পার্ক থেকে যুগলদের আটক করে বলা হয়েছিল, ‘আপত্তিকর অবস্থায়’ আটক করা হয়েছে। ওই সময় এর ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে তাদের কান ধরানোর দৃশ্য দেখা গেছে, যেটা আপত্তিকর। অপরাধীকে আটক করাই নিয়ম, কিন্তু আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া কতটা নৈতিক। যুগল বা কিশোর-কিশোরীদের আচরণ যদি আপত্তিকর, অনৈতিক হয়, তবে প্রশাসনের এই আচরণও কি অনৈতিক ও আপত্তিকর নয়? এই কিশোর-কিশোরীরা কি প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করতে পারে?

এসব উদ্ভট আচরণ না করে প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া উচিত। এই বগুড়া শহরেই আমরা তুফান সরকারদের উত্থান দেখেছি, আরও তুফান সারা দেশেই তুফান তুলছে। সারা দেশে এ রকম হাজার তুফান সরকার সক্রিয়। এদের দমন করা উচিত আইনের আওতায় এনে। মেয়েদের, নারীদের নিরাপত্তা তাতেই বরং নিশ্চিত হবে।

এবার নারায়ণগঞ্জের প্রসঙ্গে বলা যাক। পরিবারের পক্ষ অভিযোগ করা হয়েছে, তিনজনকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাজধানীর পূর্বাচল উপশহর এলাকায় তিনজনেরই গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গিয়েছে। তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলার কথা জানা যায়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, হত্যার আগে এই তিনজনকে নির্যাতন করা হতে পারে। খুবই ভয়ংকর ঘটনা! এক আতঙ্কময় পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। এ নিয়ে নতুন করে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। আগেও একই ধরনের ঘটনা শোনা গিয়েছে। অনেককেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের কেউ কেউ ফিরে এসেছে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে। কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কোথায় নিয়েছিল, কিছুই মনে করতে পারছেন না ফিরে আসা ব্যক্তিরা। আবার কেউ কেউ ফিরেও আসেনি। এখন প্রশাসনের দায়িত্ব বিষয়গুলোর সুরাহা করা। তা না হলে দুষ্কৃতকারীদের অপরাধ বাড়তেই থাকবে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের হঠকারী অভিযান পরিচালনা করে, দায়িত্ব এড়িয়ে জনমনে স্বস্তি আনা যাবে না। বরং জনসাধারণের মনে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে। এবং এটাই হচ্ছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক, ভয়, অবিশ্বাস কাজ করছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা কখনোই জনবান্ধব হতে পারেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের মতোই আচরণ করছে এখনকার প্রশাসন। জনসাধারণ মানেই ব্রিটিশ প্রশাসকের চোখে দেখা ‘আতঙ্কবাদী’, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’ না। এখন প্রশাসন ও জনসাধারণ একই স্বাধীন দেশের। প্রশাসন রাষ্ট্র কর্তৃক জনসাধারণের জন্য নিয়োজিত কর্মচারী মাত্র। প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণের ঊর্ধ্বে না মোটেই। কিন্তু বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রশাসনকে ভয় পায়। নিয়ন্ত্রক মনে করে। সেবক বা বন্ধু হিসেবে ভাবে না। এই মনোভাব পরিবর্তনের দায়িত্ব প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই নিতে হবে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।