মানবসম্পদে অগ্রগতি

বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ তিন ধাপ এগিয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৮ অনুযায়ী মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৬তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। এ সূচকে ভারতের অবস্থান ১৩০। অন্যদিকে পাকিস্তান আছে ১৫০তম অবস্থানে। ২০১৫ সালের সূচকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৩৯। এর আগে ২০১৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪২।

উল্লেখ্য, ইউএনডিপি মানবসম্পদ সূচকের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় অগ্রাধিকার দেয় তা হলো জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মাথাপিছু আয়। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পেরেছি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ দশমিক ৮ বছর। দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি। ভারতের গড় আয়ু ৬৮ দশমিক ৮ বছর আর পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ৬ বছর।

শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। জীবিত জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে নবজাতক মারা যায় ২৮ দশমিক ২ জন। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এই হার অনেক কম। আবার ১ হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে পাঁচ বছর হওয়ার আগেই মারা যায় ৩৪ দশমিক ২ জন। পাকিস্তানে তা দ্বিগুণের বেশি আর ভারতে ৪৩ জন। এগুলো ইতিবাচক দিক। কিন্তু যে বিষয়টি আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি, তা হলো সবার জন্য স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একসময় দুই হাজার সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। আজ ২০১৮ সাল। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়ে গেছে স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। প্রতিটি মানুষকে টেকসই স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পারলেই আমরা দাবি করতে পারব মানবসম্পদে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছি।

ভারতের নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের মানবসম্পদের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একই কথা প্রযোজ্য শিক্ষার ক্ষেত্রেও। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। বিশেষ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা পুরুষ শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা যখন দেখি বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি, কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি আশ্চর্যজনকভাবে কম, তখন উদ্বিগ্ন হতেই হয়। শিক্ষার লক্ষ্যই হলো মানবসম্পদের উন্নয়ন। মানবসম্পদের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে প্রতিটি শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে যে আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক আছে, তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারলে মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আশা করি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে মানব উন্নয়নের পরিমাণগত দিক শুধু নয়, তার গুণগত মানও বাড়ানো প্রয়োজন। উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য ১৬ জন চিকিৎসক ও ২০টি হাসপাতাল শয্যা লভ্য। বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা হচ্ছে ৫ ও ৬। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে ১ জন শিক্ষক গড়ে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান, উন্নয়নশীল বিশ্বে ২৫ জন। উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সূচকে যেতে হলে এই অসমতা দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অগ্রগতিকে আমরা নিশ্চয়ই উদ্‌যাপন করব। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা যেমন গতিশীল করতে হবে, তেমনি বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতেই হবে।