মায়ের চোখে শহিদুল আলম

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ফাইল ছবি
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে কারা-নিপীড়ন ভোগ করতে হবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু ঘটনাটি বাস্তব সত্য, তিনি এখনো জেলবন্দী। তাঁকে আমি জেনেছি, চিনেছি তাঁর স্বনামখ্যাত, রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত মা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর।

১৯৬৯ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রগতিশীল নারী সংগঠন গড়ে তোলার জন্য যখন সমাজসেবী, শিক্ষয়িত্রী, রাজনীতিসচেতন ছাত্রী ও নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিলাম, তখন তাঁরই পরামর্শে কাজী আনোয়ারা মনসুর ও তাঁর ছোট বোন রোকেয়া মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আনোয়ারা আপার বাসায় যাওয়ার পর তিনি তাঁর কিশোর ছেলে জাহেদের (জন্ম: ২ জুন ১৯৫৫) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ১৪ বছর বয়সের সেই লাজুক, সৌম্য কিশোরই আজকের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। কত নাম-ডাক-পুরস্কার তাঁর ৬৩ বছরের জীবনে সঞ্চিত হয়েছে-ভাবলে আনন্দ পাই। মা প্রয়াত। একটি ভাই প্রয়াত। বোন দীপু বড়। স্ত্রী স্বনামখ্যাত সাবেক অধ্যাপক, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী রেহনুমা আহমেদ। শাশুড়ি নাহার আহমেদ নারীনেত্রী এবং আলোকচিত্রী।

অনেক বছর ধরে আমার নানা রকমের গবেষণা, লেখালেখি, নারী আন্দোলন, সমাজকর্ম, অধ্যাপনাসহ বিভিন্নতার সূত্রে বহু সাংবাদিক, গবেষক, আলোকচিত্রী ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। দৃক গ্যালারি এবং তার পরিচালক শহিদুল আলম আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। সে জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে আয়োজিত সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে আলোচনাপত্রটি লিখতে গিয়ে পুনরায় উদ্ভাসিত হলেন ড. আনোয়ারা মনসুর এবং আরও প্রায় ১০০ জন পূর্ববঙ্গের নারী। ড. আনোয়ারা মনসুরের জীবনের কর্মকাণ্ড জানার জন্য তাঁর পুত্রবধূ স্নেহভাজন রেহনুমার সঙ্গে যোগাযোগ করে পেলাম তাঁর জীবন স্মৃতি বইটি (মধুকুঞ্জ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯)। মায়ের লেখায় শহিদুল আলম স্নেহে-ভালোবাসায়-দোয়ায় পরিপূর্ণতা পেয়েছেন।

মা লিখেছেন, ‘আমি ডক্টরেট করলাম ১৯৮০ সালে ঢাকায়। আর আমার ছেলে জাহেদ ডক্টরেট করল বিলাতে ১৯৮৩ সালে। জাহেদ যদিও পিএইচডি করেছে কেমিস্ট্রিতে, সে পেশায় বেছে নিল আলোকচিত্রকে। যে যে লক্ষ্যে কাজ করে আনন্দ পায়, সেই পথ বেয়েই তার সফলতা সে বয়ে আনে। আজ তো বাংলাদেশের সেরা আলোকচিত্রীদের মধ্যে তার নাম দেখে আমার আনন্দ হয়। আরও গর্ববোধ করি যখন দেখি বিশ্বের দরবারেও সে আস্তে আস্তে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আজই আমাকে সে জানাল যে ১৩ জন সেরা আলোকচিত্রীর ছবির প্রদর্শনীতে আমেরিকায় তার ছবিও অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। এ খবর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। আল্লাহ ওকে আরও কৃতিত্বের অধিকারী করুন, এই দোয়া করি।’ (পৃ.৮৯)

আনোয়ারা মনসুর আরও লিখেছেন, ‘জাহেদ বাংলাদেশে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য হলো এবং সক্রিয়ভাবেই কাজ করতে থাকল। সে আমাকে বলল, আমি বুঝতে পারছি যে আমি কোনো টেকনিক্যাল পোস্ট না নেওয়ায় আপনি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। কারণ, আপনি সবাইকে বলে বেড়ান: ছেলে কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করে এখন ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এটা সত্যি কথা, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ নিতে মোটেই আগ্রহী নই, বরং ফটোগ্রাফার আমাদের দেশে কোনো মর্যাদা পায়নি এবং সমাজে ফটোগ্রাফারদের কোনো সম্মান দেওয়া হয় না। আমি তাদের স্ট্যাটাস বাড়াতে এবং এই বিষয়ে ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে নতুন একটা ফিল্ডে বেশি উৎকর্ষ আনতে চাই।’ (পৃ.৯০)

মা বলেছিলেন, ‘ফটোগ্রাফারের (ক্যামেরাম্যানের) বউও জুটবে না এবং ভাতও জুটবে না।...অবশ্য তখন বুঝিনি যে ছেলে নিজেকে এবং তার মাধ্যমে দেশের আলোকচিত্রীদের মান অনেক উঁচুতে তুলে ধরতে বেশি আগ্রহী হয়েছিল। আল্লাহর অনুগ্রহ এবং জাহেদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দৃক পিকচার লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা হয়েছে...এই দৃকের তোলা অনেক ছবিই এখন দেশে ও বিদেশে আদৃত হচ্ছে। জাহেদের সুনামও ছড়িয়েছে আল্লাহর মর্জি। বন্ধুদের সহযোগিতায় জাহেদ ওয়ার্ল্ড ফটো প্রেসের ৮৫ তম প্রদর্শনীর আয়োজন করল, যা বাংলাদেশের জন্য অনেক গৌরব বয়ে এনেছে। এমনকি জাহেদ ১৯৯৪ সালের বিচারকমণ্ডলীর ১০ জনের মধ্যে অন্যতম জুরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার তোলা ছবির প্রদর্শনী এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হচ্ছে। একজন তরুণ আলোকচিত্রীর জন্য এটা অনন্য গৌরব এবং বাংলাদেশ তার এই সন্তানের জন্য গৌরববোধ করতে পারে বৈকি। আমরা মা-বাপ তো নিশ্চয়ই জাহেদের গৌরবে বেশি গৌরববোধ করছি। আল্লাহ ওকে আরও উন্নতি দিন সেই দোয়া করি।’ (পৃ.৯০-৯১)

মায়ের স্মৃতিচারণায় জাহেদ অনেকটা স্থানজুড়ে বিরাজ করছে। তাঁর জন্মদিনে (২ জুন) লিখেছেন, ‘জাহেদের জন্মদিন আজ। ১৯৫৫ সালের এই তারিখে সে দুনিয়ার আলো দেখেছে। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও মনে হচ্ছে ঘটনাটি যেন কালকেই ঘটেছে।...আজ জাহেদের ৩৯ বছর পূর্ণ হলো, অর্থাৎ সে ৪০শে পা দিল। ইংরেজরা নাকি এটা মানে লাইফ বিগিনস অ্যাট ফরটি। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা লাইফের অনেক দূরই পেরিয়ে যায় ৪০ বছরে। যাই হোক আমার কাছে জাহেদ এখনো ছোট্ট শিশুটি, আশায়-আনন্দে ভরা দীপ্ত চেহারা। তার এত বছরের জীবনে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। কর্মজীবনে তার আল্লাহর মর্জি সাফল্য এসেছে অনেক। আজ ঢাকায় এ-ক্লাস ফটোগ্রাফার বলতে সবাই একবাক্যে জাহেদের নাম করে।...হাঁটি হাঁটি পা পা করেই তো ছেলে এত দূর এসেছে। আল্লাহ তার অগ্রযাত্রার পথে সহায় হোন তাই দোয়া করি।’ (পৃ.১২৩-১২৪)

মায়ের চোখে দেখতে পেয়ে শহিদুল আলমকে চিনেছি অন্য রূপে। আমার-আমাদের চোখে শহিদুল আলম জাহেদ (ভাই) আরও সমসাময়িক। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া, তাঁদের ভিডিওচিত্র ধারণ করার কাজে তিনি আমার সহযোগী উৎসাহী আলোকচিত্রী। আমি তাঁর সহযোগী ভূমিকায় গর্বিত।

সাদাসিধা কোর্তা-পায়জামা পরা সাইকেল চালিয়ে তিনি চলেছেন, চলবেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে; শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তাঁর প্রয়াত মায়ের আশীর্বাদ তাঁকে অবশ্যই জেলমুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাসে বের করে আনবে। সেই দৃশ্য অবশ্যই তুলে ধরবেন তাঁরই শিক্ষায় দীক্ষিত বহু আলোকচিত্রী। আমরা তাঁর মুক্তির সেই দিনক্ষণের দাবিতে, অপেক্ষায় আছি।

আমরা শহিদুলের জীবনসঙ্গিনী রেহনুমা, শাশুড়ি নাহার আহমেদসহ সব শুভার্থীর মুখে হাসি ফোটাতে চাই।

মালেকা বেগম: নারী আন্দোলনের নেত্রী, অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা