নির্বাচনের আগাম প্রচার

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে, তা দোষের নয়।  নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীই চাইবেন জয়ী হতে এবং সে জন্য আইনের বিধান মেনে তাঁরা কাজ করবেন—এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার আগেই দল বিশেষ ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে এবং হাটে-মাঠে-ঘাটে তাকালে যে দৃশ্য চোখে পড়ছে তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন আসনে স্থানীয় নেতারা বাহারি পোস্টার ছাপিয়ে নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। কেউ কেউ সংবাদ সম্মেলন করে, জনসমাবেশের এন্তেজাম করেও প্রার্থিতার কথা জানাচ্ছেন, ভোট চাইছেন। কিন্তু সেই সুযোগটি নিতে পারছে শুধু ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগীরা। অন্যদিকে সরকারের যাঁরা প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের রাখা হয়েছে দৌড়ের ওপর। নির্বাচনের মাস তিনেক আগেই রাস্তাঘাটে যেভাবে পোস্টার লাগানো হয়েছে, তাতে মনে হবে এটি দলীয় নির্বাচন। প্রায় প্রতিটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা যেভাবে রংবেরঙের পোস্টার টানিয়ে নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন, তা কোনোভাবেই সুরুচির পরিচায়ক নয়।

যখন আওয়ামী লীগের নেতারা ট্রেন ও লঞ্চযোগে ‘নির্বাচনী যাত্রা’ চালাচ্ছেন, তখন বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে অযথা হয়রানির খবর আসছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। যখন কোনো মৃত ব্যক্তির নামে সন্ত্রাসের মামলা দেওয়া হয়, কিংবা যিনি ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থান করছেন, তাঁকে মামলার আসামি করা হয়, তখন কারও বুঝতে বাকি থাকে না যে এসব মামলা রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আগের মামলাগুলোর পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে তাঁরা ২০১৪-১৫ সালের সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু নতুন করে মামলা দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? এখন তো সে রকম কোনো ঘটনা ঘটছে না। এসব মামলার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে।

যেকোনো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত সবার জন্য সমান সুযোগ। যেখানে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রার্থীরা অবাধে নির্বাচনের আগাম প্রচার চালাচ্ছেন, সেখানে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি কেবল অনৈতিক নয়, বেআইনিও। সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রেও সরকার স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগীরা চাইলেই কোনো স্থানে জনসমাবেশ করতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে নানা বাধাবিপত্তি আরোপ করা হয়। যদিও সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে যেকোনো দল চাইলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করতে পারবে।’ আশা করি, এই দৃষ্টান্ত অন্যান্য শহর ও এলাকায়ও অনুসৃত হবে। নির্বাচন সামনে রেখে যদি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিই পালন করতে না পারেন, তাহলে তঁাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বলা প্রহসন বলেই মনে হয়। 

তফসিল ঘোষণা করা হয়নি—এই অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে, সেহেতু তাদের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। কমিশনকে মনে রাখতে হবে, তারা পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। তফসিল ঘোষণার আগে হোক আর পরে হোক—নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা তাদের কর্তব্য। তফসিল ঘোষণার আগে কোনো দল নির্বাচনী যাত্রা চালাতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না? নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হয়, এমন কিছু কেউ যাতে করতে না পারে, সেই নিশ্চয়তাও কমিশনকে দিতে হবে।