ব্যাংক ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রভাব

সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হালনাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ঋণখেলাপিদের মধ্যে আছেন একাধিক আইনপ্রণেতা। আরেকটি খবরে জানা যায়, এ বছর জানুয়ারি-জুন সময়কালেই খেলাপি হয়েছে ১০ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হিসাবে একটি আইনি কারচুপিও আছে। বিশাল অঙ্কের খেলাপিরা প্রভাব খাটিয়ে বারবার পুনর্গঠন বা পুনঃ তফসিল করে হিসাব ও তালিকার বাইরে থাকছেন। তেমনি দীর্ঘ সময় বাইরে থাকেন আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বেশ কিছু ঋণগ্রহীতা। প্রকৃত বিবেচনায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। এটি ব্যাংকব্যবস্থাকেই কাবু করে ফেলছে।

চলতি বাজেটে ব্যাংক খাতের করপোরেট করহার ২.৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। এতে রাজস্ব ক্ষতি হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। সিদ্ধান্তটি স্বভাবতই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বেশ কিছুদিন দেশে ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় নেতিবাচক খবরই আসছে। এগুলো কোনোটিই স্বস্তিদায়ক নয়। কয়েক মাস আগে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে এক মূল্যায়নে উল্লেখ করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক। এটা বিনিয়োগ ও অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তাদের মতে, আমদানির নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। সিপিডি মনে করছে, দেশের ব্যাংক খাত নষ্ট রাজনীতির শিকার। একে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা আমানতকারীদের পরিবর্তে নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকের স্বার্থ রক্ষা করছে। ব্যাংকিং বিভাগের সদ্যবিদায়ী সচিব নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ আদায়ে চাপাচাপি করার বিপক্ষে লিখিত মতামত রেখে গেছেন। এ অবস্থা পুরো অর্থনীতিকে গ্রাস করে ফেলছে। ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা এগোতে পারছেন না। বিপরীতে বেড়ে যাচ্ছে কস্ট অব ফান্ড।

অন্যদিকে ঋণের সুদহার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়ে চলছে। তবে আমানতের সুদহার ত্বরিত কমিয়ে দিয়েছে। খবরের কাগজের আরেকটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পরও কমছে না ঋণের সুদহার। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের গত অল্প সময়ে বহুবিধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক একটানা তিন মেয়াদে থাকার বিধান রেখে সংশোধিত হয়েছে আইন। ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কমিয়েছে নগদ জমার হার (সিআরআর)। সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল দিচ্ছে না। মিলছে না স্বল্প সুদের ব্যাংকঋণ। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।

আবার দেখা যাচ্ছে, একটি প্রায় দেউলিয়া ব্যাংককে উদ্ধারের জন্য সরকারি ব্যাংকের টাকা নেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি কোনো ব্যাংক এর সহায়তায় এগিয়ে আসছে না। তদুপরি বেসরকারি আরও কয়েকটি ব্যাংকে এ ধরনের দৈন্যদশা, রাতারাতি মালিকানা পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়েছে আস্থার সংকট। আগ্রাসী ব্যাংকিং ও বেশুমার খেলাপি ঋণের পাশাপাশি আমানত হ্রাস পাওয়ায় বেসরকারি খাতে শোচনীয় তারল্যসংকট দেখা দিয়েছিল। অবস্থা এতটা গভীরে যে এফবিসিসিআই পর্যন্ত ‘ব্যাংক ডাকাতদের’ শাস্তি চেয়েছে।

ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। বিনিয়োগ না হলে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হবে না। তাই এ খাতকে জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভিন্নমত নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোর অসামর্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিকাশ ঘটে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তাঁদের ঋণের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রদান, ঋণ আদায় করতে না পারা এবং একের পর এক জোর করে মালিকানা পরিবর্তন গোটা খাতকে সংকটে ফেলেছে। উদ্যোক্তা পরিচালকদের মাঝে অবশ্যই সৎ ও দেশপ্রেমিক লোক রয়েছেন। তেমনি আছেন সরকারি ব্যাংকের টাকা নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি তালিকা থেকে নাম বাদ রাখা ব্যক্তিরাও। দেশের আর্থিক খাতের গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সে প্রতিষ্ঠানটিই খেলাপিদের বড় বড় ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত দেয় যেনতেনভাবে।

কয়েক মাস আগে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক সিআরআর অনুপাত কমিয়ে দেয়। তাদের এহেন ভূমিকায় ব্যাংকিং খাতে চালকের ভূমিকায় কে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ব্যাংকিং খাতে নীতিনির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ, যুক্তরাজ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এমনকি ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বক্তব্যই চূড়ান্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থানও আইনত তা–ই। তবে প্রয়োগের সীমাবদ্ধতায় ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে আসছে। তারা যদি এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে তবে নিজেদের ভাবমূর্তির পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাত আরও বিপর্যস্ত হবে। প্রসঙ্গত, তাদের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে আসেনি। কারও দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে—এমনও জানা যায় না। এরূপ ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব কম।

সরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট না থাকলেও বাজেট থেকে নিয়মিত এদের অনেকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানো হয়। গত কয়েক বছরে এভাবে দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে সরকারের অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের লেনদেন করে কয়েকটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক। এসব লেনদেন প্রায়ই বিনা পয়সায় বা নামমাত্র কমিশনে। দীর্ঘকাল জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোতে নিরাপদে টাকা রেখে মুনাফা পাওয়ার একটি ব্যবস্থা চালু আছে। ব্যাংকের তুলনায় আমানতের বিপরীতে মুনাফার হারও বেশি। ঋণের সুদ কমানোর চাপে ব্যাংকগুলো কিছুকাল আগে আমানতের মুনাফা কমিয়ে ফেলেছে। সে মুনাফা থেকে কাটা হয় অগ্রিম আয়কর, আবগারি শুল্কসহ বিভিন্ন চার্জ। ফলে মুনাফা মুদ্রাস্ফীতিরও নিচে। সুতরাং সঞ্চয়পত্রে ভিড় বাড়বে।  সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী অনেকের এ মুনাফা পরিবার চালানোর একমাত্র মাধ্যম। বছর দুই আগেও সেখানে মুনাফার হার কমানো হয়েছে। আবারও তেমন উদ্যোগ চলছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, ব্যাংকব্যবস্থা চালু রাখতে (!) সঞ্চয় অধিদপ্তরকে অকার্যকর করার দাবি আসাও অসম্ভব নয়।

শেয়ারবাজার চোখের সামনে ধুলায় লুটিয়ে পড়ল। গত কয়েক বছর সেখানে কখনো সূচক দুই কদম এগোলে পরপরই তিন কদম পিছিয়ে যায়। অথচ বিনিয়োগের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎস শেয়ারবাজার। সেদিকে দীর্ঘকাল নজর দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় বিপন্ন আমানতকারীদের ব্যাংকের কাছেই আবার যেতে হবে। তবে মূলধন পাচার ও খেলাপি ঋণ লাগামহীন হতে থাকলে যত টাকাই ব্যাংকে দেওয়া হোক না কেন, তা শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে।

এ দেশে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব ব্যাংকিং গড়ে উঠুক, এটা সবাই চাইবেন। আর আমাদের এ ছোট দেশটিতে ব্যবসা, শিল্প ও ব্যাংকিং সব খাতেই একই ব্যক্তি, পরিবার বা গোত্র কাজ করছে। অভ্যাসগতভাবে ঋণখেলাপি না হলে ব্যাংক খাতে এই নৈরাজ্য আসত না। আর ঋণ বিতরণ, পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যক্তিরা অন্যায্য সুযোগ নিয়ে চলছেন। এর অংশীদার রয়েছেন ব্যাংকের অসাধু পরিচালক ও কর্মকর্তারা। তাঁদের লোভের শিকার আজকের ব্যাংক খাত। আগে দোষ দেওয়া হতো সরকারি ব্যাংককে। এখন বেসরকারি খাতেও একই সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও এদের তুষ্ট করতেই সচেষ্ট। সমস্যা দিনে দিনে ঘনীভূত হচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট সবাই এবার অন্তত পিছে ফিরুন।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]