হারছে যুক্তরাষ্ট্র, জিতছে চীন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। রয়টার্স ফাইল ছবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। রয়টার্স ফাইল ছবি

চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন যে বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন রপ্তানি শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পণ্য ঢুকলে চীনকে ১০ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। কিন্তু এখন চীন থেকে পরবর্তী ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সায় দিয়ে বলেছেন, ‘শুল্ক মানে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ, শুল্ক মানে সম্পদ।’

এখন কথা হচ্ছে, কর্মসংস্থান আর সম্পদই যদি বাণিজ্যযুদ্ধে জেতার মোক্ষম অস্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে এই যুদ্ধে আমেরিকার নয়, চীনেরই জিত হবে। চীন জিতবে শুধু এই কারণে নয় যে দেশটিতে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম আছে। এটি অবশ্যই ঠিক যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ‘প্রতিকূল আবহাওয়া’ মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে যথেষ্ট সহায়তা করবে।

এর বাইরে চীনের নিশ্চিত জয়ের আরও একটি বড় কারণ হলো, চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক সতর্কভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পা ফেলছে। চীনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করলে যুক্তরাষ্ট্রকে যে শুল্ক দিতে হবে, তার বেশির ভাগই আমদানিকারক হিসেবে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করতে হবে। প্রদেয় শুল্কের খুব কম অংশই দিতে হবে চীনা কোম্পানিকে। যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন তাদের এবং তাদের দেশে বিনিয়োগ করা বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রতিও নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে।

আমেরিকা মনে করছে, এমনভাবে চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করতে হবে, যাতে চীনা অর্থনীতি চরম বেকায়দায় পড়ে এবং বাধ্য হয়ে চীনা নেতারা মার্কিন বাণিজ্য আলোচকদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেধাসম্পত্তি নকলের বিষয়টি স্বীকার করেন এবং সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর চীনের অর্থনীতি নির্ভর করে; এ কারণেই চড়া শুল্ক বসিয়ে দিলে চীন আমেরিকার দাবির সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

কিন্তু এই কৌশল নিশ্চিতভাবেই আমেরিকার জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে। কারণ, প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে চীনের যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, তার ৬০ শতাংশই উৎপাদিত হয় চীনে প্রতিষ্ঠিত এমন সব কারখানায়, যেগুলোর মালিক চীন নয়। এসব কারখানার মালিক চীনে বিনিয়োগ করা বাইরের দেশের বিভিন্ন কোম্পানি। এসব কোম্পানির অনেকগুলোই আমেরিকান প্রস্তুতকারকদের জন্য তাদের ফরমাশ মোতাবেক কম্পিউটার রাউটার, এলইডি ফিকশ্চার এবং নৌযান মোটরের মতো নানা ধরনের কাস্টমাইজড ইনপুট তৈরি করে থাকে। তার মানে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করছে, সেটি মূলত চীনে কারখানা গড়ে বাণিজ্য করা বহু আমেরিকান ও ইউরোপীয় কোম্পানির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব কোম্পানি এই বর্ধিত শুল্ক এড়াতে রাতারাতি চীন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। এর বদলে তারা আমেরিকাকে বর্ধিত শুল্ক দিয়ে যাবে। এই বাড়তি শুল্কের খরচ পুষিয়ে নিতে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। এতে আমেরিকান ভোক্তাদের বাড়তি খরচ গুনতে হবে। এটি ইতিমধ্যে শুরু হয়েও গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে চীনা ওয়াশিং মেশিনের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পর আমেরিকার বাজারে এই পণ্যের দাম গড়ে ১৬.৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে শুল্ক বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে বাড়তি রাজস্ব আয় করছে, তার বেশির ভাগ যাচ্ছে মার্কিন নাগরিকদের পকেট থেকে; চীনা কোম্পানিগুলোর তহবিল থেকে নয়। বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনা যত বাড়ছে, চীন তত বিদেশি কোম্পানিগুলোকে তার দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে। অন্যদিকে ঠিক উল্টো কাজ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। তারা ধারাবাহিকভাবে আমেরিকাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। গত জুনে চীন ব্যাংকিং, কৃষি ও ভারী শিল্পে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আসার পথ সুগম করে দিয়েছে। নানা ধরনের শর্ত শিথিল করেছে।

গাড়ি নির্মাণপ্রতিষ্ঠান টেসলাকে চীন স্থানীয় কোনো অংশীদার রাখার শর্ত ছাড়াই একক মালিকানায় চীনের মাটিতে কারখানা গড়ার অনুমতি দিয়েছে। এটি অন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দারুণভাবে উৎসাহিত করছে। এতে চীনের কর্মসংস্থান বাড়ছে। অন্যদিকে বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে চীনা পণ্য কিনতে গিয়ে মার্কিন নাগরিকদের আগের চেয়ে বেশি পয়সা খরচ করতে হবে। এতে মার্কিন জনগণের মনে তাদের সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। যেসব দেশের কোম্পানি চীনে বিনিয়োগ করে এখন বাড়তি শুল্কের চাপে পড়েছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে যাবে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। 

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

মেরি ই লাভলি: যুক্তরাষ্ট্রের সাইরাকজ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক