কে হবেন প্রেসিডেন্ট, সিসি না সাবাহি

আবদেল ফাতাহ আল-সিসি, হামদিন সাবাহি
আবদেল ফাতাহ আল-সিসি, হামদিন সাবাহি

মিসরীয়রা এখন পড়েছে নতুন দোলাচলে। বিশেষ করে ঝানু বামপন্থী হামদিন সাবাহি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর। ২০১২ সালে যে নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাতে সাবাহি অধিকার করেছিলেন তৃতীয় স্থান। সাবাহির এই ঘোষণা এল আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে, যে নির্বাচনে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাতাহ আল-সিসির প্রার্থী হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বছরের জুন মাসে মিসরজুড়ে বিক্ষোভের মুখে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উচ্ছেদ করে সিসি আরবের সবচেয়ে জনবহুল দেশে বিপুল জনপ্রিয় হন।
মিসরীয়রা এখন যার যার রাজনৈতিক পক্ষ, মতামত ও আদর্শিক অবস্থান থেকে তর্ক ও আলোচনা চালাচ্ছে। সেসব আলোচনা প্রকাশ্যে উঠেও আসছে। এরই একটা উদাহরণ হলো ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট আর তামারোদ মুভমেন্টের এক সারিতে চলে আসা। প্রথমটি গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের শেষে মুরসি প্রশাসনের বিরোধিতা করার জন্য আর গত বছরজুড়ে বিক্ষোভ সংঘটিত করে যাচ্ছিল তামারোদ, যার পরিণতি হলো মুরসির অপসারণ। এমনকি তাদের নামকরণও বোঝায় যে একই উদ্দেশ্যে তারা গঠিত। এবং অবশ্যই তাদের সঙ্গে ছিল নাসেরপন্থীসহ বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী। এই বামপন্থীদের থেকেই এসেছেন সাবাহি।
মিসরের এখন প্রতিটি বাড়িতেই কান পাতলে শোনা যাবে সিসি আর সাবাহিকে নিয়ে আলোচনা। সব পরিবারই যেন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে: এই দুজনের কে হবেন মিসরের যোগ্যতম প্রেসিডেন্ট?
এ বছরের গোড়াতেই প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের তৈরি করা সংবিধান স্থগিত করে আধুনিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক মিসরের লক্ষ্যে নতুন সংবিধান পাস হয়েছে। তা ছাড়া ইসলামপন্থী আমলের অভিজ্ঞতা ফিরে আসার যে ভয় সবকিছু আচ্ছন্ন করে ছিল, তা কাটিয়ে মিসরীয়রা এখন এমন একজন সেনানায়ক চায়, যিনি তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করবেন। এই সেনানায়ক ‘ধর্মের’ লেবাসের আড়ালে ভেসে ওঠা পুনর্জীবিত সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করছেন। ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের বিতাড়নের পর থেকে মিসরের অর্থনীতি যে নাটকীয় দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা থেকেও উঠে আসার লক্ষণমিলছে।
এখনকার মিসরে সাবাহি ও সিসির (যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য উর্দি খুলে নামবেন বলে ভাবা হচ্ছে) মধ্যে কে ভালো হবেন তা নিয়ে দোলাচলের সঙ্গে অতীতের দোলাচলের কোনো তুলনা চলে না। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতো করে সাবাহিও একে বর্ণনা করেছেন ‘ভালো’ আর ‘উত্তমের’ মধ্যকার লড়াই বলে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারির গণ-অভ্যুত্থান এবং তার সংশোধনে আসা ৩০ জুনের ঘটনার সমর্থক বিপ্লবীদের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা এ রকমই। আজকের পরিস্থিতি ২০১২ সালের থেকে এখানেই আলাদা যে তখন মিসরীয়দের বেছে নিতে হচ্ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি বনাম মোবারকের শাসনের প্রতিনিধি আহমেদ শফিকের মধ্যে। সে রকম অবস্থায় পরিস্থিতিটা ছিল ‘খারাপ’ আর ‘নিকৃষ্টের’ মধ্যকার প্রতিযোগিতার মতো। অথবা ব্যাপারটা ছিল যেন কলেরায় মরব নাকি প্লেগে মরব; তা বাছাই করে নেওয়ার প্রশ্ন।
মিসরে চলমান বিতর্কের বিষয় দুই প্রার্থীর মধ্যকার মিল ও ভিন্নতা নিয়ে। দুজনই জনপ্রিয় হওয়ায় বেছে নেওয়াও কঠিন হয়ে গেছে ভোটারদের পক্ষে। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সাবাহি বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন যে আমি সব মিসরীয় ও সিসিকে বলছি, তিনি একজন উত্তম প্রার্থী, তবে আমিও ‘উত্তম’ প্রার্থী হতে পারি।
প্রখ্যাত মিসরীয় রাজনীতিবিদ মোহামেদ সালমাওয়ি এককথায় এভাবে বলেছেন, সাবাহি ও সিসি এই অর্থে মিসরীয়দের চোখে সম্পর্কিত যে উভয়ই তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সাবেক জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের কথা। সিসি যেভাবে জনগণের ইচ্ছাকে তুলে ধরেছেন, যেভাবে তিনি আন্তর্জাতিক শক্তি ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর বিপরীতে জনগণের স্বার্থকে গ্রহণ করেছেন, তাতে অনেক মিসরীয়র মনেই তাঁকে নাসেরের প্রতীক বলে মনে হয়।
অন্যদিকে সাবাহি হলেন নাসেরের সরাসরি অনুসারীদের মধ্যে প্রধানতম নাসেরপন্থী নেতা। বাল্যকাল থেকেই তিনি নাসেরপন্থার সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে চিত্রিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নাসেরপন্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের নির্বাচনেও তিনি নাসেরপন্থী হিসেবেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেন, যেমন এখন তিনি সংসদে নাসেরের ধারারই নেতার ভূমিকা পালন করছেন।
সালমাওয়ি আরও বলেন যে ২০১৪ সালের নির্বাচনী দৌড়ে সিসি আর সাবাহিই হবেন প্রধান প্রতিযোগী। এর অর্থ হলো, যে নাসের তাঁর পরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাতের আমলে ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, সেই নাসেরের প্রত্যাবর্তন ঘটছে। এখন তাহরির স্কয়ারে নাসেরের পোস্টারের পাশে শোভা পাচ্ছে সিসির পোস্টার। আর তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘মুক্তি, ইনসাফ ও মানবতার সম্মান’-এর জন্য।
সাবাহি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সিসি একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি এবং আমি তাঁর জন্য শুভকামনা ছাড়া অন্য কিছু বোধ করি না। কারণ, তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বর্তমানের মতোই তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থানে থেকে যাওয়া।’
সাবাহি যুক্তি দেন, চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজনের চাপে যদি সিসি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নির্বাচন
কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসির নির্বাচিত হওয়া তেমন অবধারিত নয়, যদিও গণমাধ্যম ও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তেমনটাই ভাবেন।
এরই মধ্যে প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক মোহামেদ হাসানাইয়েন হেকেল নিজের অতীতের উক্তি সংশোধন করে বলেন যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে মিসরের দরকার অলৌকিক ঘটনা। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে সিসিই ন্যায্য প্রার্থী। তিনি আরও বলেন, সিসি যদিও অনেক জনপ্রিয়তা উপভোগ করেন, তাহলেও অন্যান্য প্রার্থীও নিজেদের মনোনীত করতে সক্ষম হবেন। আর এটা ঘটতে হবে সত্যিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়।
হেকেল বলেন, সাবাহির মনোনীত হওয়া খুবই ন্যায়সংগত। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক মেধা রয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হওয়া থেকে শুরু করে পরের দিকে তিনি নিজেকে জাতীয় রাজনীতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিকশিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, সাবাহির তেমন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও জনপ্রিয় সমর্থন। এই সমর্থন দিচ্ছে তরুণ উৎসাহী জনতা। এ কথা বলে
তিনি ইঙ্গিত করেন ২০১২ সালের নির্বাচনের কথা, যেখানে সাবাহি পেয়েছিলেন ৫০ লাখ ভোট। ওই নির্বাচনে সাবাহির সাফল্য বিস্ময়কর ছিল। কারণ, অন্য প্রার্থীরা বিপুল অর্থ ও যোগাযোগ বিনিয়োগ করে তাঁর জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছিলেন।
সিসির প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পথে হুমকি হলো মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনের সমর্থকদের পুনরাবির্ভাব। এরা যদি সিসিকে সমর্থন দেয়, তাহলে মিসরের ভেতরে ও বাইরে তাঁর প্রতিপক্ষ সুবিধা পাবে। আর তাহলে গত বছরের ৩০ জুন মিসরীয় সেনাবাহিনী মুরসিকে উচ্ছেদ করে যে বাহবা কুড়িয়েছিল, তাতে চিড় ধরবে।

কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।