সমালোচক মানেই কি ভয়ংকর অপরাধী?

১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের পক্ষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘এই যুদ্ধে যদি রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দিতে না পারি, রাষ্ট্র যদি বিপন্ন হয়, তাহলে অপরাধটা আমাদেরই হবে।’ অতি উত্তম কথা। রাষ্ট্র নিয়ে তিনি এবং তাঁর সরকার খুবই চিন্তিত। আইনটি না করা গেলে রাষ্ট্রের ওপর গজব নেমে আসবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।

গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাঁরা, তাঁদের একটা বড় অংশ সরকারের সমর্থক। তাঁদের অনেকেই এই আইনের সমালোচনা করছেন। তাঁদের দাবি, এই আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মুক্তচিন্তার পথকে বাধাগ্রস্ত করবে। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, মামলা হলে থানায় দারোগার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে হবে বিষয়টি ‘অপরাধের’ পর্যায়ে পড়ে কি না, বা ‘অভিযুক্ত’ কত ভয়ংকর যে তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিতে হবে।

পাশের দেশ মিয়ানমার। সেখানে দশকের পর দশক ধরে চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসন। মিয়ানমার রাষ্ট্রটি যে মারাত্মক রকম গণবিরোধী এবং মিয়ানমার সরকার যে নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার ও গণমাধ্যম মোটামুটি একমত। তো সে দেশের একটি সংবাদ খুব ছোট করে ছেপেছে এ দেশের একটি দৈনিক, ভেতরের পাতায়।

কিন্তু খবরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। খবরে প্রকাশ, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করার অভিযোগে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের সাবেক এক কলাম লেখককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাজা পাওয়া এই লোকের নাম নাগার মিন সোয়ে। স্টেট কাউন্সেলর সু চির বিরুদ্ধে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট লেখার জন্য তিনি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সু চি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে খারাপ অনুভূতি তৈরি করতেই তিনি এ কাজ করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ (সূত্র: এএফপি, ইয়াঙ্গুন)।

মিয়ানমারেও ৫৭ ধারা বা ৩২ ধারা অথবা এ–জাতীয় ব্যাপারস্যাপার আছে কি না, জানা নেই। তবে সে দেশে বাক্স্বাধীনতা আছে, এমন দাবি আমাদের দেশের কট্টর মিয়ানমারপ্রেমীও করবেন কি না সন্দেহ। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখায় রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে মিয়ানমারের একটি আদালত কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সরব হলেও আমাদের এখানে তা কোনো ঢেউ তুলতে পারেনি। মনে হয়, এই দুই দেশের গণমাধ্যমের অবস্থায় সাদৃশ্য হয়েছে। সরকারকে চটালে তার ফল ভালো হয় না।

এ দেশে এই আইন তৈরির শুরুটা কখন কীভাবে হয়েছিল, জানি না। অনেকেই বলাবলি করেন, ফেসবুকে নানান উসকানিমূলক তথ্য ও মন্তব্যের লাগাম টেনে ধরার জন্যই নাকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ফেসবুকে হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আছে। এটা মানতেই হবে যে এসব গুজব যাঁরা ছড়ান, তাঁদের অন্য মতলব থাকতে পারে।

প্রশ্ন হলো, সবাই কি গুজবে বিশ্বাস করেন? সবাই কি ফেসবুক ঘেঁটে তথ্য নেন এবং সে অনুযায়ী রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েন? গুজব ছড়ানো যেমন নিন্দনীয়, তেমনি এ নিয়ে অতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো মানে হয় না।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের আড়াআড়ি। গণমাধ্যমকে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হয়। টিকে থাকার জন্যই তাকে ক্রমাগত পেশাদার হয়ে উঠতে হয়। মিথ্যা বা ভুল তথ্য ছেপে খুব বেশি পাঠক বা দর্শককে বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। তা যদি যেত, তাহলে চটকদার সংবাদ পরিবেশনকারী ট্যাবলয়েড বা অনলাইন মাধ্যমগুলো আরও জনপ্রিয় হতো। কিন্তু তা হয়নি।

মিথ্যা বলব না, তবে অপ্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বহীন সংবাদ প্রচার করে আমাদের বিটিভি তার আবেদন হারিয়েছে অনেক দিন আগেই। বিটিভি অনেক মানসম্মত অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচার করে, যেখানে বেসরকারি চ্যানেলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। কিন্তু বিটিভির সংবাদ একেবারেই নীরস, একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর।

তবে সরকার যদি গণমাধ্যমের ‘অবাধ স্বাধীনতা’ না চায়, তাহলে বিটিভি ছাড়া অন্যদের সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। এ দেশে যখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না, তখন সবাই কি বিটিভির সংবাদের জন্য মুখিয়ে থাকত? বিশ্বাস করত?

গণমাধ্যম যদি নিয়ন্ত্রিত হয়, কিংবা যদি এতে মনোপলি তৈরি হয়, তখন যোগাযোগের অনেক বিকল্প মাধ্যম ও প্রক্রিয়া তৈরি হয়ে যায়। আর এভাবেই এ দেশে সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারবিরোধী জনমত তৈরি হয়েছিল। আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

আমরা যখন উপনিবেশ ছিলাম, আমাদের যখন গোলাম করে রাখা হয়েছিল, তখন আমাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই ছিল অসহিষ্ণু। সবকিছুর মধ্যেই তারা ষড়যন্ত্র দেখত। সরকারের সমালোচনা মাত্রই ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ। ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান’ আইন বানিয়ে তারা বিরোধীদের দিনের পর দিন বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখত। এর অন্যতম ভুক্তভোগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এটা ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকের কথা। পাকিস্তান গণপরিষদে সংবিধান তৈরির তোড়জোড় চলছে। ৩ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকারের উদ্দেশে সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা বলে থাকেন যে বাক্স্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।

আপনি কি জানেন যে, পূর্ববঙ্গে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না; আপনারা ওটা ছাপাতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি। পূর্ব বাংলা সরকার লিখুক আর কেরানি লিখুক, সেটা বড় কথা নয়। নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে যে আপনি বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবেন না। সরকারের তরফ থেকে একজন ইনসপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে, আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।...

‘স্যার, আমরা সারা দেশের জন্য একটা সংবিধান তৈরি করতে যাচ্ছি। এখানে বসা ৮০ জন ব্যক্তির জন্য শুধু নয়। আমরা চাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত করতে।...

‘এটা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে পারবেন এবং জনমত গড়ে তুলতে পারবেন।’

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর অনুগত সৈনিকদের আস্ফালন দেখে কি বিস্মিত হতেন? রাষ্ট্রকে হাতের মুঠোয় আনতে পারলে রাজনীতিবিদেরা কেমন বদলে যান!

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]