শিশুদের সাঁতার শেখাবে কে?

সাঁতার জানা প্রত্যেক মানুষের জন্য জরুরি
সাঁতার জানা প্রত্যেক মানুষের জন্য জরুরি

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন আর নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের প্রভাবস্বরূপ বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকা সারা বছরই থাকছে পানির নিচে আবার কোনো কোনো এলাকা হয়ে পড়ছে জলাধারশূন্য। উভয়ই বাড়িয়ে দিচ্ছে পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি। শৈশবে কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’ কবিতায় পড়েছিলাম, ‘জলে না নামিলে কেহ শেখে না সাঁতার/ হাঁটিতে শেখে না কেহ না খেয়ে আছাড়।’ ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের অধিকাংশ শিশু সাঁতার না শিখে বড় হচ্ছে। কারণ, জলাধার থাকলে তবেই না জলে নামার বিষয়টি আসে। আর জলে নামলে তবেই না শেখা হবে সাঁতার। শহরের শিশুরা সাঁতার শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পানিতে প্রাণ হারানোর ঝুঁকির মধ্যে বড় হচ্ছে।

অন্যদিকে জলমগ্ন এলাকার শিশুরাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। পানির আশপাশে বেড়ে ওঠা এসব শিশু পারিবারিক ও সামাজিক নানা অসচেতনতা আর সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রায়ই পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে পানিতে ডুবে, যা সেই বছরে অপ্রত্যাশিত মোট মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ।

আর পানিতে ডুবে মৃত্যুর বেশির ভাগই ঘটে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে গড়ে প্রতিদিন ৫৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে পানিতে ডুবে। এই সংখ্যাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি আধা ঘণ্টায় একজন মানুষ পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৯৬ জন পানিতে পড়ে আহত হয়—যাদের সংবাদ প্রায় অপ্রকাশিতই রয়ে যায়।

বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রায় ৪৩ শতাংশের কারণই পানিতে ডুবে মৃত্যু। বিষয়টি বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলেও তা প্রতিরোধে কিংবা প্রতিকারে সরকার তৎপর নয়। বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি হ্রাস নিয়ে কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নয়। তারা আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি মোকাবিলায় কাজ করছে এবং জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলছে।

দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকির বিষয়টিকে মাথায় রেখে দুর্যোগকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পড়ালেখার ক্ষতির পরিমাণকে সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য নানা পরিকল্পনাও গ্রহণ করছে। কিন্তু আকস্মিক এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়, প্রতিদিনের দুর্যোগ পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে তাদের সেই সচেতনতা কিংবা প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হয় না। অথচ পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু কেন জানি না প্রতিদিন ঘটে যাওয়া এ দুর্যোগ সম্পর্কে আমরা এখনো সে অর্থে বিচলিত হই না, সচেতনও নই।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো শিক্ষার্থী। তাই শিক্ষার্থীর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর উচ্চ হারকে মাথায় রেখে প্রয়োজন শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে সাঁতার শেখানোর নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই শিশু, সেই দেশের বিপুলসংখ্যক শিশুকে সাঁতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে প্রয়োজন সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

২০১৫ সালে একবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎকালীন মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক সাঁতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হবে সংক্রান্ত একটি পরিপত্র প্রকাশ করে। নিকটবর্তী স্থানে জলাধার না থাকা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক না থাকা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ইত্যাদি সত্ত্বেও বিষয়টি মাঠপর্যায়ের স্কুলগুলোতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এবং তদারকির অভাবে এমন সুন্দর একটি উদ্যোগ ব্যর্থতায় রূপ নেয়। আর প্রাথমিকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আজও গ্রহণ করা হয়নি। সিআইপিআরবির জরিপ অনুযায়ী রোজ ৪০ জন শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা যায়, যাদের বয়স ১ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। শুধু শিক্ষার্থীর জন্যই নয়, শিক্ষকদের জন্যও চাই সাঁতার শিক্ষার সুযোগ।

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সাঁতার শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরাও কি পারি না প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে সাঁতারকে অন্তর্ভুক্ত করতে? জানি, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা। কিন্তু থেমে থাকলে চলবে কেন! শহরের স্কুলগুলোতে জলাধারের অভাব রয়েছে সত্য। কিন্তু গ্রামের স্কুলগুলোতে শিশুদের সাঁতার শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্কুল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন এবং শিক্ষা কর্মকর্তার সমন্বয়ে ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনায় স্থানীয় পুকুর কিংবা জলাশয়ে পালাক্রমে শিশুদের সাঁতার শেখাতে যেতে পারে। শহরের স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতারের কোর্স চালু করতে পারে বিভিন্ন সুইমিং পুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে। এর জন্য বাড়তি ফি আদায় করলেও অভিভাবকেরা আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না। প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাঁর সন্তান সাঁতার জানুক, যা শেখা শহরের যান্ত্রিক জীবনে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

শিশুদের সাঁতার শেখানোর এই পরিকল্পনা এক দিনে বাস্তবায়িত হবে না। বরং ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রয়েছে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আর দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব। এ ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগও জরুরি। মনে রাখা দরকার, সাঁতার শুধু জীবন দক্ষতামূলক একটি শিক্ষা নয় বরং এটি জীবনকে রক্ষাকারী একটি কৌশলও বটে। সাঁতার জানা প্রত্যেক মানুষের জন্য জরুরি।

নিশাত সুলতানা, লেখক ও গবেষক
[email protected]