'বেগম' চুরি: বাংলাদেশের গন্ডারেরা কেন হারাল?

লন্ডন চিড়িয়াখানায় বেচে দেওয়া বাংলাদেশের শেষ গন্ডার ‘বেগম’–এর ছবি এঁকেছেন ইংরেজ শিল্পী।
লন্ডন চিড়িয়াখানায় বেচে দেওয়া বাংলাদেশের শেষ গন্ডার ‘বেগম’–এর ছবি এঁকেছেন ইংরেজ শিল্পী।

কয়েক মাস আগে আসামের মানস জাতীয় উদ্যানে গিয়েছিলাম। সাধ ছিল বুনো পরিবেশে নিজ চোখে একবার গন্ডার দেখে নিজেকে ধন্য করব। সত্যি যখন চেখের সামনে একটি ভারতীয় একশিঙ্গি গন্ডার হেলেদুলে হাঁটছিল, ভালো লাগার পাশাপাশি মনের গভীরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া তিনটি দুঃখ ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহযাত্রীদের বলেছিলাম, আমাদেরও এককালে তিন প্রজাতির গন্ডার ছিল!

২২ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব গন্ডার দিবস। আজ আমাদের গন্ডারেরা বেঁচে থাকলে হয়তো বিশ্ব বাঘ দিবসের মতো বিশ্ব গন্ডার দিবস পালন করতাম। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমরা হারিয়েছি শত বছর আগেই। গন্ডার (Rhinoceros বা Rhino) একপ্রকার স্তন্যপায়ী তৃণভোজী প্রাণী। এটি রাইনোসেরোটিডি পরিবারের অন্তর্গত। পৃথিবীতে বুনো পরিবেশে পাঁচ প্রজাতির গন্ডার বাস করত। যার দুটি ছিল আফ্রিকায় ও তিনটি ছিল এশিয়ায়। কী সৌভাগ্য ছিল আমাদের যে এশিয়ার তিনিটি গন্ডার প্রজাতির সবই ছিল আমাদের এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। কালের বিবর্তনে বসতি হারিয়ে, শিকারির শিকার হয়ে সব গন্ডার হারিয়েছি আমরা। অতীত নথিপত্র, জেলাভিত্তিক গেজেটিয়ার, ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ কর্তৃক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তরে তিস্তা অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তিন প্রজাতির গন্ডারের বসতি।

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত এই তিন প্রজাতির গন্ডারের বসতির বিস্তৃতি ছিল যথাক্রমে: Indian rhinoceros (Rhinoceros unicornis) একশিঙ্গি বড় গন্ডার নেপাল সিকিম থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। Javan rhinoceros (Sunda rhinoceros) সুন্দরবন, যশোর থেকে বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। সুন্দরবন ও যশোর থেকে শিকার করা এমন ১১টি একশিঙ্গি ছোট গন্ডার কলকাতা, বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে তৎকালীন সময় নিয়ে যাওয়া হয়। Sumatran(Didermoceros sumatrensis) দুইশিঙ্গি গন্ডারের আবাস কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ছিল।

১৮৭৬ সালে কুমিল্লায় একটি দুইশিঙ্গি গন্ডার গুলি করে মারা হয় এবং ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে একটি গন্ডার ধরা হয়। যেটি ছিল দুইশিঙ্গি গন্ডার।

ছবিটি অস্পষ্ট ঠিক তার করুণ ইতিহাসের মতোই। ছবিটি দুই শিংবিশিষ্ট গন্ডারের, যেটি ছিল বাংলাদেশের শেষ জীবিত গন্ডার ‘বেগম’।

১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের দক্ষিণের কোনো এক স্থানে এটি মানুষের হাতে বন্দী হয়। চোরাবালিতে আটকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল গন্ডারটি। স্থানীয় লোকজন গন্ডারটিকে চোরাবালি থেকে তুলে আটকে রেখে প্রশাসনকে জানান। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ক্যাপ্টেন হুড ও মি. উইকস আটটি হাতি নিয়ে ১৬ ঘণ্টা কঠোর চেষ্টার পর এটিকে বন্দী করে। অর্থের লোভ সামলাতে পারেনি তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তা। লন্ডন চিড়িয়াখানা এ খবর পেলে দীর্ঘ সময় দর-কষাকষির পর ১৮৭২ সালে গন্ডারটিকে পাঁচ হাজার পাউন্ডে কেনে। নিজ বসতভিটা ছেড়ে বেগম বন্দী হলো লন্ডনের খাঁচায়। এই গন্ডারের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের গন্ডার প্রজাতি। এত বড় বাংলায় আমরা ‘বেগমের’ জন্য একটু জায়গা করে দিতে পারিনি। আমাদের লোভ, প্রভুদের খেতাব পাওয়ার আশা হয়তো সেদিন ভিজেছিল ‘বেগমের’ চোখের পানিতে। আজও সে লোভ–নিষ্ঠুরতা ভিজে ধুয়ে যেতে পারেনি হাজারো বন্য প্রাণীর চোখের পানিতেও।

লন্ডন চিড়িয়াখানায় তার নাম দেওয়া হল ‘বেগম’। লন্ডনে মি. কিউলমান নামের এক আঁকিয়ে আঁকলেন মানুষের নজরে আসা বাংলাদেশের জীবিত শেষ গন্ডারের ছবিটি।

সুন্দরবন এলাকায় পাওয়া গন্ডারের ফসিল হাতে লেখক।
সুন্দরবন এলাকায় পাওয়া গন্ডারের ফসিল হাতে লেখক।

যা হোক, ১৮৬৮ সালের দিকে বাংলাদেশের শেষ গন্ডারের কথা বলা হলেও সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০০ সালের শেষ দিকে বা ১৯০০ সালের প্রথম দিকে সুন্দরবনের নলিয়ান থেকে একটি গন্ডার Javan rhinoceros (Sunda rhinoceros) শিকার করের কালাচাঁদ নামের এক শিকারি। খুলনার রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী শেষ ১৮৮৫ সালে সুন্দরবনে গন্ডারের পায়ের চিহ্ন দেখেছিলেন। তারপর সুন্দরবনে বা বাংলাদেশের কোথাও গন্ডারের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সুবাদে সমগ্র সুন্দরবন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫–১৬ সালে বাঘবিষয়ক একটি গবেষণা কার্যক্রমের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়। মাঠপর্যায়ের সেই গবেষণাকালে আমার দলের নাম দিয়েছিলাম টিম রাইন (গন্ডারের দল)। এই নামের উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবন থেকে গন্ডারের মতো প্রাণীর বিলুপ্তির কথা মনে রেখে বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে চলা এব সেই সঙ্গে এত বড় একটি বনে বাঘের স্থান হলেও গন্ডারের বিলুপ্তির কারণ যাচাই করা। যা হোক, সম্ভবত বনভূমি ও ইতিহাস অনুসন্ধানে বুঝেছিলাম সুন্দরবনে তৃণাঞ্চলের ঘাটতি ও অবাধ শিকারই গন্ডার বিলুপ্তির কারণ।

ইতিহাস ও সদ্য আবিষ্কৃত প্রত্নস্থল ঘেঁটে তার সত্যতাও পেয়েছিলাম। একসময় সুন্দরবনে চামড়া, শিং ও মাংসের জন্য ব্যাপক আকারে গন্ডার শিকার করা হতো। প্রাচীনকালে সুন্দরবন অঞ্চলের আদিবাসীরা গন্ডারের মাংস খেত। সুন্দরবনের প্রাচীন প্রত্নস্থলে তারই নমুনাস্বরূপ একটি গন্ডারের দাঁতের জীবাশ্ম-প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি অবশ্য অন্যান্য প্রাণীর হাড়ের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অন্য আরেক প্রত্নস্থলে পাওয়া যায় পায়ের হাড়, যা দেখে অনুমান করা যায় হাড়ের ভেতরের মজ্জা বের করার জন্য ভাঙা হয়েছিল হাড়টি।

সুন্দরবনের গন্ডার নিয়ে আরও অনুসন্ধানে সুন্দরবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সেকেন্দার ডাক্তার তাঁর জীবদ্দশায় একটি পুকুর খননের সময় মাটির গভীরে দুটি গন্ডারের কঙ্কাল পান। এ ছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন হরিণগড় গ্রামে এফাজতুল্লা সরদার পুকুর খননের সময় একটি গন্ডারের কঙ্কাল, ধূমঘাট দিঘি খননের সময় ছয়টি গন্ডারের কঙ্কাল ও ঈশ্বরীপুর মাখন লাল অধিকারীর বাড়িতে ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক এ এফ এম আবদুল জলিল ছয়টি গন্ডারের কঙ্কাল দেখেন। তিনি আরও উল্লেখ্য করেন, ‘প্রায় একশত বৎসর পূর্বে বৃদ্ধ লোকেরা শ্রীফলাকাঠি ও খেগড়াঘাটের জঙ্গলে স্বচক্ষে গন্ডার দেখিয়াছেন।’

সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসরত ঢালী পদবির লোকজন সুন্দরবনে গন্ডার শিকার করে তার চামড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য ঢাল প্রস্তুত করত। ঢাল থেকে পেশাগত কারণে ঢালী পদবির উৎপত্তি। এই ঢালীরা মহারাজ প্রতাপাদিত্যর হয়ে যুদ্ধ করত। পরবর্তী যুগে এসে ইংরেজ শিকারিদের ব্যাপক শিকারের ফলে অবশিষ্ট গন্ডার সুন্দরবন থেকে বিলীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এখনো অনেক গ্রাম, বাজার, নদী-খাল আছে যার নাম গন্ডারের স্মৃতিবিজড়িত। যেমন গাড়াখালী, রামপাল অঞ্চলের গাড়ামারা ইত্যাদি। এ ছাড়া সুন্দরবন অঞ্চলে পশু ধরার ফাঁদকে স্থানীয়ভাবে কল ও গন্ডারকে গেঁড়া বলা হতো। প্রচণ্ড শক্তিশালী গন্ডার ধরার ফাঁদ অত্যন্ত মজবুত হতো। অন্যান্য প্রাণীর জন্য এই ফাঁদ থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। ফলে প্রচলিত ‘গেঁড়াকল’ উপমাটির উৎপত্তিও এই অঞ্চলেই হয়ে থাকতে পারে।

ইসমে আজম: সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণকর্মী ও বাঘ গবেষক এবং সুন্দরবনে আদি সভ্যতার প্রত্নস্থলের আবিষ্কারক