যাচ্ছ যাও, আবার ফিরে এসো এহসান

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমাদের শেষ উপায় হলো ‘দেশান্তর’ বা ‘নির্বাসন’। প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশিকে বিদেশে পালাতে বাধ্য করা গেলে দেশে জনসংখ্যার চাপও কমবে, সরকারও একটা শান্তশিষ্ট তেলচিটচিটে জনগণ পেতে পারবে। আর এ কাজ করার জন্য যোগ্য হলেন সরকার ও সরকারি দলের (কখনো কখনো পুলিশের সহযোগী) উন্নয়নের সহযোগী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্র, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ‘সোনার ছেলে’রা। উন্নয়ন ও মানবাধিকার চর্চায় তাঁদের এই সম্ভাবনা আপনারা ভাবতে পারেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ (এসএম) হলের ছাত্র এহসানকে ওই হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী বেদম পিটিয়ে ভর্তা বানান। এতে এহসানের একটি চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়। তাঁকে ভারতে পাঠিয়ে চোখের অস্ত্রোপচার করায় তাঁর পরিবার। সেই থেকে এহসান নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন, তাঁর মানসিক আঘাতের ধাক্কা আর কাটেনি। গত মাসে এহসান দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় চলে গেছেন। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সেখানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়েছেন। ইতিমধ্যে একটি শিক্ষাবর্ষ হারিয়ে গেছে তাঁর জীবন থেকে।

কারণ?

কারণ, ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগের যে সাত নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছিল, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন প্রশাসনের শাস্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন বলে হলেই থাকছেন। এমনকি যাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের কথা বলা হয়েছে, তিনিও হলে সগৌরবেই আছেন। বহিষ্কৃত প্রত্যেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সময় দিচ্ছেন। সেটা তো দেবেনই। দেশপ্রেমের জন্য কোনো লাইসেন্স বা স্বীকৃতির দরকার হয় না। প্রেম থাকলেই হলো। সেটা আছে বলেই ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতারা ক্যাম্পাসে থেকে দেশপ্রেমিকের কর্তব্য সারছেন। আশা করি, এভাবে আরও কয়েকজনকে পিটিয়ে তাঁরা পগারপার, অর্থাৎ দেশান্তরী করতে পারবেন।

কোনো মহৎ কাজই প্রশাসনের উদার হস্তের স্পর্শ ছাড়া হতে পারে না। আহত হওয়ার পর এহসান আতঙ্কে আর ওই হলে ফিরতে চাইছিলেন না। এহেন কাবু অবস্থায় তিনি অন্য হলে সিট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর আরজি জানান। বিজ্ঞ প্রশাসন যথারীতি তাঁর প্রস্তাবটি বাতিল করে দিয়ে বলেছে, ‘উঁহু, সেটি সম্ভব নয়।’ ওদিকে রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর হাতুড়িপেটায় কোমর ভেঙে পড়ে ছিলেন এত দিন। এখন পরীক্ষা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যাম্পাসের মেডিকেল সেন্টারের অসুস্থ শয্যায় শুয়ে পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন করলে দরদি প্রশাসন অনুমতি খারিজ করে। হয়তো তারা চেয়েছিল কষ্ট করে আর পরীক্ষা দেওয়ার দরকার কী! তরিকুলও এহসানের মতো বিদেশে চলে যাক না! কিন্তু তিনি যাননি বা যেতে পারেননি। বরং বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে পরীক্ষা হলে আসতে বাধ্য হন এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পরীক্ষা শেষ না করেই চলে গেছেন।

সোনায় সোহাগা দিলে যেমন হয়, প্রশাসনের এমন আদরে ছাত্রলীগ নেতারা গলে যান, তাঁরা সোনার ছেলের মর্যাদায় ক্যাম্পাসে যথাযোগ্য ক্ষমতা ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে বিরাজ করেন। এহসানদের তাই দেশ ছাড়তে হয়।

এ প্রক্রিয়া চালু থাকলে ভিতু, প্রতিবাদী, মাইরের ওষুধ সেবনে ব্যর্থরা যে যেভাবে পারেন দেশ ছাড়বেন। আর আমরা দেশের ‘সোনার ছেলে’দের ভরসায় এগিয়ে যাব। ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কর্মসূচির ফজিলতও বহুমুখী। জনসংখ্যাও কমবে, কিছু মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে দেশের ‘উপকার’ করবে।

তবে সমান্তরাল আরেকটি প্রক্রিয়ার কথাও ভাবা যায়। যেভাবে দণ্ডিত অপরাধীরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা দ্বারা শোধিত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, সেটাও দেশের প্রতিভা বিদেশে পাঠানোর একটা পথ। এ প্রক্রিয়া আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকারীরাও এভাবে বিদেশে রপ্তানি হয়েছিলেন। দেশের অনেক জঙ্গি, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাসী, খুনিরা ওই মহাজ্ঞানী মহাজনদের পথ ধরে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। অপরাধ করে ধরা-খাওয়া মন্ত্রী-সাংসদপুত্ররা দেশের আদালতের সীমার বাইরে অহরহই চলে যাচ্ছেন। বাঙালি জাতির বিশ্বায়ন ঘটানোয় তাঁরা অবদান রাখছেন।

অনেক বিরোধী দলের কর্মীও দেশছাড়া হয়েছেন। কোটা সংস্কার ও ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আন্দোলনে নির্যাতিত ও হুমকিগ্রস্তদের কেউ কেউ দেশ ছাড়ছেন। এত এত চমৎকার দৃষ্টান্ত থাকায় দেশান্তরের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির ভার ছাত্রলীগের হাতে তুলে দেওয়া যেতেই পারে। পাশাপাশি ‘রিএনফোর্সড’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলবৎ হওয়ায় এই পথ আরও সুগম হবে। যাঁরা নির্ভয়ে কথা বলতে চান, তাঁরা বিদেশে বসে সেটা বলতে পারবেন। দাঁতের ডাক্তারের কাছেও যাঁরা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, তাঁরা বিদেশে সেটা করতে পারবেন।

কিছুদিন আগে প্রথম আলোতেই ‘দেশ ছাড়ব না কেন?’ শিরোনামে একটা কলাম লিখি। তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি, ‘গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরেই ত্যাগ করেছেন ২৯৯ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইটি দক্ষতাসম্পন্ন বাংলাদেশিরা দেশ ত্যাগ করছেন। নাগরিকত্ব ত্যাগের হার দিন দিন বাড়ছে। [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ জুন]

‘দেশ কিন্তু এখন মহা উন্নত, মহাপরাক্রমশালী। নৌকাযোগে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশিরা মহাপরাক্রমে সবার সামনে। এদিকে সব ক্ষেত্রেই যোগ্যরা ভেসে উঠছে। তলিয়ে যাচ্ছে “অযোগ্য” তথা সৎ, সাহসী ও নিষ্ঠাবান মানুষেরা।

‘নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসার তালেও দেশান্তর বাড়ছে। ধনী ও নেতাদের বড় অংশই এক পা শুধু নয়, বাড়িঘর, ব্যাংক-ব্যালান্স, পরিবারের অর্ধেক বাইরেই রাখছেন। অদৃষ্টপূর্বভাবে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় রাজধানীতে বাংলাদেশিদের ‘সাহেবপাড়া” ‘বেগমপাড়া” গড়ে উঠেছে বলে রটনা আছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, ধনী ও ক্ষমতাবানদের বড় অংশই মনে করে, বাংলাদেশ বাস করা যায় না। লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর স্বীকৃতি দিয়েছে। ঢাকা হয়েছে বিশ্বের মধ্যে বসবাসের অযোগ্য সেরা দ্বিতীয় শহর । রাজধানী দেশের প্রচ্ছদ, ঢাকাকে দেখে দেশের অবস্থা বোঝা কঠিন নয়। সুতরাং, যত দ্রুত পারেন টাকা কামিয়ে সটকে পড়াই ভালো!’

পরিস্থিতি একদম দেশত্যাগের বসন্তের মতো। ‘গত বছরে প্রথম আলো পরিচালিত তারুণ্য জরিপ বলছে, ৮২ শতাংশের বেশি তরুণ ভবিষ্যতে দেশের ভেতরে কর্মক্ষেত্র নিয়ে ভরসা রাখতে পারছেন না। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউই) থেকে করা জরিপেও দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণ দেশ ছাড়তে চান। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের “একবার যেতে দে না, আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়” গানের কথা কাউকে আর আটকাতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও যথেষ্ঠ কর্মসংস্থানের দরজা না খোলায় তরুণেরা হতাশ। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৬৩ শতাংশই বলছে, তারা জানে না তাদের জীবনের লক্ষ্য কী। ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণের ভয় নিরাপত্তা নিয়ে।’

কিন্তু কিছু উন্নয়নবিরোধী কিছুতেই দেশ ছাড়বে না। তারা মাটি কামড়ে দেশে থাকবে। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলামের মতো জেলবাসী হবে। রাষ্ট্র মেরামতের জেদ পুষে রাখবে অনেক কিশোর-তরুণ। কেউবা দারুণ আবিষ্কার করবে, কেউ জনসেবার প্রতিষ্ঠান গড়বে, কোনো বিজ্ঞানী উদ্ভাবন করবেন যুগান্তকারী কোনো প্রযুক্তি। শস্যবিশ্বাসী কৃষকেরা মাটিতে ভাগ্য পুঁতবেন, শিকড় আরও গভীরে ছড়াবেন। সেই সব আমজনতা, সেই সব কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র, সেই সব শিল্পী ও শিক্ষক, সেই সব অদূরদর্শী বাংলাদেশপন্থী গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য ‘উন্নয়নের’ কিছু সমস্যা হবে। সেটা মোকাবিলা করেই ২০৪১ সাল কেন, ২১০০ সাল পর্যন্ত আমরা এগিয়েই যাব। কেউ আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

কিন্তু মুশকিল হলো, বাংলার মাটি বড় বেয়াড়া। এ মাটিতে বাম্পার ফলনের মতো সাহসী মানুষেরা জন্মে। এত কোমল মাটিতে এত কঠিন জেদ কেমন করে যে জন্মায়, কে জানে? সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের কথা এরা ভোলেনি। সম্ভবত শহীদ বীরেরা এ জাতির হৃদয়ে সাহসের ডিএনএ পুরে দিয়েছিলেন। ক্রিকেটের মাঠে মাশরাফিকে দেখে হঠাৎ করে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বলে ভুল হয়, ভাঙা হাঁটু নিয়ে সংশপ্তকের মতো জেদে যে লড়ে যাওয়া দেখে বুকে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার জাগে। সাহসী কিশোরদের জাগরণ দেখে মনে হয়, এ দেশ টিকবে। এ দেশ আবার আমাদের হবে।

এহসানেরা হয়তো তখন ফিরে আসবে। দেশটা বাসযোগ্য করার কাজ হাতে তুলে নেবে। এ ছাড়া তো উপায় দেখি না।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]