বিএনপি বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে তো?

রাজনীতে এখনকার আলোচিত বিষয় হলো ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’। এ নিয়ে মাঠে-ঘাটে, কাগজে-ফেসবুকে, চায়ের টেবিলে তুফান উঠেছে। দেশটা তো অনেক আগে থেকেই বিভক্ত। এত আড়াআড়ির রাজনীতি আর কোনো দেশে আছে কি না, জানি না। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে দাবি করতেই পারি। সব জায়গায় যখন বিভক্তি, তখন ঐক্যের কথা শুনতে কার না ভালো লাগে। প্রশ্ন হলো, এটি আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দেবে, নাকি বিভক্তির মেরুকরণ আরও স্পষ্ট ও তীব্র করবে। কেউ কেউ বলছেন, এখন তো পর্যবেক্ষণের পালা। সময়ই বলে দেবে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি।

শুরুটা হয়েছিল কক্ষচ্যুত পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে। একসময় তাঁরা ঘোষণা দিলেন ‘তৃতীয় শক্তির’। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি–বলয়ের বাইরে আলাদা একটি তরঙ্গ তৈরির চেষ্টা। তো এদের একটি পক্ষ—কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এই প্রক্রিয়া থেকে অবসরে গেছে। বাকি চারটি পক্ষ, অর্থাৎ গণফোরাম, বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য এবং জেএসডি এখনো একসঙ্গে আছে। এদের নেতারা ‘জাতীয় ঐক্যের’ ডাক দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় বিএনপিও যোগ দিয়েছে। কয়েক দিন আগে মহানগর নাট্যমঞ্চে তাঁরা হাত-ধরাধরি করে একজোট হয়ে কাজ করার কথা ঘোষণা করলেন। সমাবেশে তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ উপস্থিত হয়ে নতুন মাত্রা দিলেন। সবাই তাঁকে সৎ ও সাহসী মানুষ হিসেবেই চেনেন। আবার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেনের উপস্থিতি দেখে অনেকেই ভুরু কুঁচকেছেন—ইনি এখানে কেন?

মুখে যে যা-ই বলুন না কেন, নতুন এই সমীকরণের পথ ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বাইরে একটি বিস্তৃত প্ল্যাটফর্ম তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ কী ভাবছে, তা জানা খুবই জরুরি। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রথমে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়ে এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তিনি অবস্থান পাল্টেছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে সুদখোর-ঘুষখোরদের ঐক্য হয়েছে, এক-এগারোর কুশীলবেরা আবারও সক্রিয় হচ্ছে ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন। তবে শোভনীয়তার বৃত্তের মধ্যে থেকে যে সমালোচনাটি তাঁরা করেছেন, তা হলো আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য হয় কী করে। একেবারে খাঁটি কথা। এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ যেহেতু নেই, ধরে নিতে হবে এটা হলো আওয়ামী লীগবিরোধী ঐক্যচেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই সব ছোট দলের বড় বড় নেতারা কি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপির পেটে সেঁধিয়ে গেলেন?

উল্লেখ্য, এই ঐক্য প্রয়াসে সবাই এককাট্টা নন। বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য আর জেএসডি মিলে তৈরি করেছে ‘যুক্তফ্রন্ট’। এর প্রধান নেতা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’। এই দুইয়ের সমন্বয়ে যা হতে যাচ্ছে বা হতে পারে, তার নামকরণ হয়নি এখনো। এর সঙ্গে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যোগ দিলে যে কাঠামোটি দাঁড়াবে, তার নামকরণের প্রশ্নও আসবে। বেশ কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেমন বিএনপি একা আসবে, না তার সব জোটসঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। বিএনপির অন্যতম জোটসঙ্গী হলো জামায়াতে ইসলামী। এই দলকে নিয়ে অনেকেরই আছে অস্বস্তি ও আপত্তি। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত হলো বিএনপির দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের অনেকেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতকে সঙ্গে রাখতে চান না। বিষয়টির একটি মীমাংসা হওয়া দরকার।

ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দুরকম ভাবনা দেখা গেছে। কারও কারও চোখে জামায়াত একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং বিএনপি যদি এই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়, তাকে আসতে হবে জামায়াতকে ছেড়ে। কেউ কেউ ভাবছেন, যে কারণে এই ঐক্য প্রয়াস, সেখানে জামায়াত মূল ইস্যু নয়। মূল ইস্যু হলো একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায় করে নেওয়া। বোঝা যাচ্ছে, এ নিয়ে আরও টানাপোড়েন তৈরি হবে এবং কেউ কেউ ঐক্যজোটের গাড়ি থেকে ডিগবাজি দিয়ে নেমে পড়তে পারেন। ইতিমধ্যে তেমন কিছু কিছু আলামত চোখে পড়েছে। এখানে সরকারি দলের উসকানি বা কান ভাঙানির ‘ষড়যন্ত্র’ও দেখছেন কেউ কেউ।

বিএনপির কাছে একটি বড় প্রশ্ন হলো জামায়াত এ সময় তাদের সম্পদ, না বোঝা। জামায়াতকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কামাল-বদরুদ্দোজা-রব-মান্নানদের সঙ্গে এক মঞ্চে উঠলে তাদের লাভ হবে, নাকি ক্ষতি হবে। সমস্যাটি জামায়াতের নয়, বিএনপির। অন্যদিকে বিএনপি যদি গোঁ ধরে সে জামায়াতকে ছেড়ে আসবে না। সে ক্ষেত্রে ঐক্যজোটের নেতারা কি বিএনপিকে ছেড়ে নিজেদের শক্তিতে দাঁড়াতে পারবেন?

আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই বলছে, জামায়াতকে সঙ্গী করে স্বাধীনতাবিরোধীরা আবারও একজোট হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক সংলাপের যে অনুরোধ এত দিন জানিয়ে আসছিল, আওয়ামী লীগ বরাবরই তা নাকচ করে দিয়ে বলেছে, জামায়াত সঙ্গী হলে বিএনপির স‌ঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। তবে বিএনপি যদি জামায়াতকে সঙ্গে না রাখে, তাহলে আওয়ামী লীগের কোনো সুবিধা হবে না। জামায়াতের লোকেরা নৌকা মার্কায় ভোট দেবে না। বরং তারা একটি আওয়ামীবিরোধী সরকারের জন্য অপেক্ষা করবে, যেখানে তাদের পুনর্বাসনের পথটি সহজতর হবে।

ঐক্যজোটের নেতারা এখন পর্যন্ত দাবি করে আসছেন যে তাঁদের লক্ষ্য হলো একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করা। এটা নির্বাচনী জোট এখনো হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয়, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের অ্যাজেন্ডায় অন্য সবার সঙ্গে আওয়ামী লীগও শামিল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা হবে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময়। এবার এ রকমটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কেননা, আওয়ামী জোটের বাইরে সবাই একটি ব্যাপারে একমত যে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন জিইয়ে রেখেছে এবং তারা যেনতেন প্রকারে বা জোরজবরদস্তি করে নির্বাচনে জিতে আবার ক্ষমতায় যেতে চায়। সে ক্ষেত্রে যদি সবাই এককাট্টা হয়ে
কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হয় এবং নির্বাচন সামনে রেখে একটা গণজোয়ার তৈরি করতে পারে, তা আওয়ামী লীগের সামনে একটি বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। আওয়ামী লীগ এমনটাই আশঙ্কা করছে এবং এই জোটের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রচারে নেমেছে।

প্রশ্ন হলো, এই জোট টিকবে কি না। ন্যূনতম দাবি বা কর্মসূচির ভিত্তিতে এককাট্টা হতে পারলে জোট টিকে যায়। সে ক্ষেত্রে একটি বা দুটি দাবি বা লক্ষ্যই যথেষ্ট। দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে কোনো জোটই এক বা দুই সপ্তাহের বেশি টিকবে না। এখন যারা এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছেন, তঁারা চান একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতির কাঠামো তৈরি হোক। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন জোটের আপত্তি থাকার কথা নয়। এরপরও কথা থাকে, ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়া বিএনপি ভবিষ্যতে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে কি না।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]