ইন্দোনেশিয়ায় সুনামিতে এত মৃত্যুর দায় কার?

ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের ভূমিকম্প আর সুনামির খবর এখনো টাটকা, কারণ লাশ এখনো পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ভাঙা দালানে আটকে পড়া মানুষের আর্তি শোনা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া লাশের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০-এর বেশি। মৃত আর আটকে থাকা জীবিতের অনুসন্ধান এখনো চলছে; সেই সঙ্গে চলছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পারস্পরিক দোষারোপ।

অস্বাভাবিক উচ্চতার সুনামির কারণ কী?
সুনামিতে সৃষ্ট প্রায় ছয় মিটার উঁচু ঢেউ পালু শহরকে ভাসিয়ে দেয়। ঢেউয়ের উচ্চতা পালু শহরের সবাইকে অবাক করে দেয়। অবাক হয়েছেন বিজ্ঞানীরাও। তাঁদের ধারণা, ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের বিকৃতি ৪৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এতে সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত সুনামি হতে পারে। কিন্তু ছয় মিটার পর্যন্ত নয়। অন্য কিছু ঘটতে পারে। সম্ভাব্য দুটি কারণ হচ্ছে বিশাল ভূমিধস ও উপসাগরে তৈরি ফানেল। পরিবর্তনের বিষয়টি বুঝতে বাথিমেট্রিক জরিপ করতে হবে। উপগ্রহের মাধ্যমে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে ভূমিধস বিশেষজ্ঞ ডেভ পেটলি ধারণা করছেন, ভূমিকম্পের কারণে ভূপৃষ্ঠের একটি বিশাল এলাকা উধাও হয়ে যায়। এলাকাটায় আগে বসতি ছিল। এ ঘটনাকে লিকুইয়াফিকেশন বলা হয়, যাতে ভূপৃষ্ঠের গঠন ভেঙে পড়ে এবং সক্রিয় ভূমিধসের সৃষ্টি করে। ডেভ পেটলি বলছেন, সরেজমিনে এলাকা পর্যবেক্ষণ করলে প্রকৃত ঘটনা আর তার প্রভাব পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। গবেষকেরা বলছেন, ভূমিকম্পের ফলে পানির নিচের ভূমিধসের কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এতে সৈকতের দিকে বড় ধরনের ঢেউ আঘাত হানে থাকে।

ভূমিধস বা ডেভ পেটলি যাকে লিকুইয়াফিকেশন বলছেন, ইন্দোনেশিয়ায় সেটা নতুন কোনো নতুন ঘটনা নয়। এ বছরের জানুয়ারিতে জাকার্তার সদ্য নির্মিত নামজাদা স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের লবি হঠাৎ হারিয়ে যায় মাটির গভীরে। এর তিন মাস পর ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল বান্দুগ শহরের এক শিল্পকলা কেন্দ্র ধসে পড়লে নৃত্য ও সংগীত শিক্ষার্থী সাতজন তরুণ-তরুণী মারা যান। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের কারণে এবং ভূগর্ভের ক্রমবর্ধমান পানি শূন্যতা পূরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এ ধরনের বিপর্যয় যেকোনো সময় ঘটতে পারে। ঘটছেও। আমরাও ঢাকা শহরসহ সারা দেশে একই কাজ করেই চলছি। এমনকি ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা (যেমন টেকনাফ অঞ্চল) এখন বাদ যাচ্ছে না।

স্বাভাবিক বন ধ্বংস করে পাহাড়ে কম সময়ে বেশি আয়ের অর্থকরী চাষ বাস কিংবা অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণ পাহাড়কে সামান্য দোলায় অথবা কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে যে হড়কিয়ে দিতে পারে, সে তো আমরা পার্বত্য জেলাগুলো আর কক্সবাজারে হরদম দেখছি। ইন্দোনেশিয়ায় এই নাজুকতা বাড়ছে বহুগুণে। ভূমিকম্প আর সুনামি ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র।

সুনামির প্রস্তুতিও কি যথেষ্ট ছিল?
ইন্দোনেশিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডিজাস্টার মিটিগেশন এজেন্সি (বিএনপিবি) বলছে, ঠিকমতো সুনামি পূর্বাভাস দিতে পারলে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করা যেত। কিন্তু টাকার অভাবে ছয় বছর ধরে সব কলকবজা বিগড়ে আছে। প্রতিবছরেই আমাদের কাজের জন্য বরাদ্দ কমছে। এটা না বলে বিএনপিবির কর্মকর্তাদের কোনো উপায় ছিল না। সময়মতো পূর্বাভাস দিতে না পারা আবার সুনামি আঘাত হানার আগে সুনামির সম্ভাবনাসংক্রান্ত সতর্কতা প্রত্যাহার করার অভিযোগের সব কটি আঙুল এখন তাদের দিকেই তাক করা। ইন্দোনেশিয়ার সুনামি বিশেষজ্ঞ আবদুল মুহারির মতে, এত দিন শুধু বাতচিত চলেছে, আসলে ইন্দোনেশিয়া সুনামি চিহ্নিত করা আর পূর্বাভাস প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। তাঁর মতে, ইন্দোনেশিয়ার মতো একটা ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটা থেকে পাঁচটা সিসমোগ্রাফ আর সাগরের পানির বিভিন্ন স্তরে সুনামি সংকেত বোঝার জন্য বয়া রাখা দরকার। এসব ঠিকঠাক রাখার পরেও জাপান ২০১১ সালে সেভাবে প্রাণহানি কমাতে পারেনি। আর ইন্দোনেশিয়া তো খালি হাতে বসে আছে।

ইন্দোনেশিয়া একদম খালিহাতে বসে ছিল, সেটা বলা যাবে না। ২০১১ সালের জাপানি সুনামির পর তারা জাপানি অনুদানে একটু নড়েচড়ে বসেছিল বৈকি। বিএনপিবির মুখপত্র মি. সুতপো জানিয়েছেন, শুরুতে সব ঠিকঠাক চললেও ‘চাটার দল’ সব শেষ করে দিয়েছে। চোরেরা সব বয়া চুরি করে নিয়ে গেছে। যা দু-একটা পড়ে আছে, তা অকেজো, বেকার। বরাদ্দের অভাবে অকেজোগুলো বদলানোর উপায় নেই।

এ তো গেল পূর্বাভাসসংক্রান্ত প্রস্তুতির হালসাকিন। উদ্ধারের প্রস্তুতিতেও নানা ফাঁকফোকর ছিল। সাভারের মতো সেখানেও মানুষ আটকে পড়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে, বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু উদ্ধারের যন্ত্রপাতি যাদের কাছে থাকা দরকার, তাদের কাছে নেই। প্রান্তিক জনপদ আর জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার সংস্কৃতি আমরা লালন করতে গিয়ে এই অবস্থা।

তৃতীয় বিশ্বের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাসন বা গভর্ন্যান্সের মূল সমস্যা হচ্ছে—
১. ভুল আগ্রাধিকার।
২. অনুদানে কেনা যন্ত্রপাতি, বানানো ইমারত, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ না রাখা; দাতার প্রকল্প শেষ আমাদেরও কাজ শেষ।
৩. জনগণকে সঙ্গে না রাখা—জনগণের স্বত্বাধিকার বা ওনারশিপ প্রতিষ্ঠাকে কর্মসূচির ভিত্তি মনে না করা। সবশেষে—
৪. জবাবদিহি বলে কিছু না থাকা।

তবে এটাও ঠিক, মূল শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির জায়গা না থাকলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তা যুক্ত হওয়ার কোনো কায়দা নেই। একদল বয়া লাগাবে আরেক দল সেটা বাড়ি নিয়ে চৌকির নিচে রেখে দেবে। ঝড়, সুনামি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে মানুষ মরবে। সবাই কাঁদবে, আবার বয়া কেনা হবে, আবার তা চৌকির তলায় বা কম্বলের নিচে হারিয়ে যাবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণকর্মী, গবেষক