নারী আসন, কেউ কথা রাখেনি

‘রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে নারীর সমান অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের নারী নীতি পুনর্বহাল ও কার্যকর করা হবে, বৈষম্যমূলক আইনসমূহের সংস্কার করা হবে এবং সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষিত করা হবে।’

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের রূপকল্প ২০২১-এর ঘোষণা।

২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল। ১০ বছরের ব্যবধান। এর মধ্যে নবম সংসদ পার হয়ে দশম সংসদের মেয়াদও শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের কিংবা প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের অঙ্গীকার পূরণের কোনো লক্ষণ নেই। বরং ক্ষমতাসীন দল ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে আগামী ২৫ বছরের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনে অপ্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে একটি আইন পাস করিয়ে নিয়েছে।

যেকোনো আইন পাস করার সময় অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করার রীতি আছে। কিন্তু নারী সাংসদ আইন পাসের আগে কোনো নারী সংগঠন বা নারী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। বহু বছর থেকেই বিভিন্ন নারী সংগঠন সংসদে নারীর আসনসংখ্যা এক–তৃতীয়াংশ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের কাছে একটি বিলের খসড়াও স্পিকারের কাছে পেশ করা হয়, যাতে সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫০ এবং সংরক্ষিত নারী আসন ১৫০ করার কথা বলা হয়েছিল। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, নির্ধারিত ৩০০ আসনের প্রতি দুটি আসন নিয়ে সংরক্ষিত একটি নারী আসনের এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। আমাদের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোতে যেভাবে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো বিন্যস্ত করা হয়, এটি অনেকটা সে রকম। আবার অনেকের বিকল্প প্রস্তাবও ছিল। ৩০০ আসন থেকে ১০০ আসন আলাদা করে সেখানে শুধু নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের জন্যও অনুরূপ আসন সংরক্ষণের দাবি রয়েছে।

১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ নারী আসনে প্রত্যক্ষ ভোটের ব্যবস্থা করে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিরা নানা বৈষম্য–বঞ্চনার শিকার হলেও ব্যবস্থাটি নারীর ক্ষমতায়নে এক ধাপ অগ্রগতি বলেই ধারণা করি। কিন্তু বর্তমান সংসদ ২৫ বছরের জন্য যে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করল, সেটি ঠিক তার উল্টো। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন আরও অনেক ধাপ পিছিয়ে দেওয়া হলো। এরশাদের আমলে নারী সাংসদদের ৩০ সেট অলংকার বলে যে উপহাস করা হতো, রাজনৈতিক দলগুলো সেই অবস্থান থেকে খুব বেশি এগোতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সাধারণ আসনে নির্বাচিত অনেক পুরুষ সাংসদ এই নারী সাংসদদের ‘আপদ’ বলেই মনে করেন। এ নিয়ে নারী সাংসদেরা মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ করলেও কাজে আসেনি। সংরক্ষিত আসনের একজন সাংসদ আক্ষেপ করে বলেছেন, নারীরা যোগ্য হলেও অনেক সময় মনোনয়ন দিতে চায় না দলগুলো । মনে করে, নারীদের অর্থবিত্ত নেই। টাকার বিনিময়ে রসগোল্লা খেয়ে ভোট দেয়। পরে রসগোল্লার দাম তুলে নেয়। সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের উপজেলা-জেলা পরিষদ থেকে কোথাও কোনো দাম নেই। কোনো কাজ নেই।

স্বাধীনতার আগে থেকে জাতীয় সংসদে নারী সাংসদেরা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। সেখানে নারী সাংসদেরা প্রত্যক্ষ ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন ।

সংসদে যখন সংরক্ষিত নারী আসন রাখা হয়েছে, তখন আমরা ধরে নিতে পারি, নীতিনির্ধারকেরা এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছেন না। প্রশ্ন হলো, সেই নারী আসনগুলো পূরণের উপায় কী হবে? ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই ওয়াদা করেছিল যে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করা হবে এবং সেসব আসনের প্রতিনিধিরাও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু নির্বাচনের পর সেই অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ বেমালুম ভুলে গেছে। বিএনপি বলতে পারে, তারা গত ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তারা নারী আসনসংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করেছিল এবং নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের আইন করেছিল। এর আগে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত, সেই দল থেকেই সব নারী সাংসদ নির্বাচিত হতেন। বিএনপির সেই আইনের সুফল এখন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো ভোগ করলেও তাদের কেউ সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের কথা ভাবছে না। এটি দুর্ভাগ্যজনক।

২০১১ সালে যে নারী উন্নয়ন নীতি করা হয়, তার ৩২.৭ অনুচ্ছেদে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩৩ শতাংশ আসন বাড়ানো এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। ২০১১ সালে যেটি নারীর অগ্রগতির জন্য জরুরি মনে হয়েছিল, সেটি এখন পরিত্যাজ্য হলো কেন? পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ৫০ করা হলো (এর আগে বিএনপি সরকার ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করে) সে সময়েও নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই মনে করেননি ব্যবস্থাটি দীর্ঘস্থায়ী হবে। কিন্তু ৭ বছর পর তাঁরা ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত আসন বহাল রাখলেন এবং তা–ও অপ্রত্যক্ষ ভোটে। অর্থাৎ তাঁরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন না, হবেন জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত।

মহিলা পরিষদের অন্যতম দাবি ছিল, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে নারী-পুরুষের সম–অধিকারসহ সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে
তোলার অঙ্গীকার থাকতে হবে।’ তারা নারী নির্যাতনকারী সন্ত্রাসী গডফাদার, মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী কাউকে মনোনয়ন না দেওয়ার কথা বলেছে। প্রায় অনুরূপ দাবি তুলেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও।

২০০৮ সালের রাজনৈতিক দলবিধিতে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশ পদ নারীদের দ্বারা পূরণের যে বিধান জারি হয়েছিল, ডান–বাম–মধ্য কোনো দলই সেটি করেনি কিংবা করার প্রক্রিয়ায় নেই। বড় দলগুলোর প্রেসিডিয়াম, সম্পাদকমণ্ডলী ও কেন্দ্রীয় কমিটি দেখলেই সেটি স্পষ্ট। যে আওয়ামী লীগ নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেই আওয়ামী লীগই নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারী সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে তোয়াজ করে চলছে। সংগঠনটি ২০১৩ সালে ঢাকা শহরে যে তাণ্ডব করেছিল, তা কারও অজানা নয়। মৌলবাদী শক্তিকে তুষ্ট করে নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা সমতাভিত্তিক সমাজ, কোনোটাই হবে না।

সংবিধানের দশম অনুচ্ছেদে আছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ অনুচ্ছেদ ২৮(২): ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৮০ সালে এক স্মারক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ।...যে সমাজ তার অর্ধেক অংশকে পঙ্গু করে, তারা নিজেকেই নিজে পঙ্গু করে রাখে। এর অর্থ হচ্ছে এক হাত বেঁধে রেখে যুদ্ধ করা।’

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এক হাত বন্ধ রেখেই যুদ্ধ করছেন, যদিও প্রায় তিন দশক ধরে এই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান পদে নারীরাই আসীন আছেন।

আমরা অনেক বিষয়ে বিশ্বের রোল মডেল দাবি করলেও সংসদে নারী আসনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানেরও পেছনে আছি। পাকিস্তানে ৩৩০ জন সাংসদের মধ্যে নারী সাংসদ আছেন ৬৮ জন। আর বাংলাদেশে ৩৫০ জন সাংসদের মধ্যে নারী সাংসদ ৭১ জন (২০.৩ শতাংশ)। এর মধ্যে ৫০ জন এসেছেন সংরক্ষিত কোটায়। নেপালে নারী সাংসদের হার ৩২.৭ শতাংশ। পৃথিবীতে নারী সাংসদের দিক থেকে পয়লা নম্বরে আছে রুয়ান্ডা ৬১.৩ শতাংশ, এরপর কিউবা ও বলিভিয়া যথাক্রমে ৫৩.২ ও ৫৩.১ শতাংশ আসন নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে। এমনকি আরব আমিরাতেও নারী সাংসদের হার আমাদের চেয়ে বেশি ২২.৫ শতাংশ। (সূত্র: ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন।)

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে আছি।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি