কয়লা ও পারমাণবিক কেন্দ্র: জার্মানি ও বাংলাদেশ

জার্মানিতে দেশজুড়ে বিপুল বনভূমি রয়েছে। দেশটির মূল আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগই বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। অনেক অনেক বনভূমির মধ্যে নর্থরাইন ভেস্টফালেন রাজ্যের বনভূমির নাম হামবাখার ফ্রস্ট। বন ও কোলন শহরের সন্নিকটে রাইন নদীর পশ্চিমাঞ্চলে বিশাল এলাকাজুড়ে হাজার বছরের পুরোনো হামবাখার ফ্রস্টে গাছগাছালির সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য জলাশয়। এই বনভূমির অস্তিত্ব নিয়ে টান পড়েছে, কারণ কাছের কয়লাখনি সম্প্রসারণের জন্য বনভূমির বিশাল অংশের বৃক্ষ নিধন করতে হবে। এই বনভূমি উজাড় হোক, প্রকৃতিপ্রেমীরা তা চান না। তাই মধ্য আগস্ট থেকে বনভূমিতে অবস্থান করে গাছের ওপর অস্থায়ী ঘর স্থাপন করে বন উজাড়ের প্রতিবাদ করছেন।

জার্মানির মতো দেশজুড়ে বনভূমি হয়তো বাংলাদেশে নেই। তবে বাংলাদেশের আছে সুন্দরবন, যা অনেক দেশেই নেই। জার্মানির পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক ক্যাথরিন ফিঙ্কে তাঁর সুন্দরবন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে ‘ডের জাইট’ পত্রিকায় লিখেছেন ‘কেউ যদি নৈসর্গিক স্বর্গের সন্ধান করতে চান তবে তাঁর বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্যটি দেখা উচিত। জীববৈচিত্র্যময় এই বনে আছে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর ২৫০ প্রজাতির পাখি। এসব কারণে ২০১০ সাল থেকে এই বিরল বনভূমি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। অথচ ওই নৈসর্গিক বিরল বনভূমি এখন বিপদাপন্ন। কারণ এই বনভূমির অদূরেই রামপালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে।’ জার্মানির আরেক পত্রিকা সুদ ডয়েচে জাইটুং পরিবেশবিষয়ক পাতায় সুন্দরবনের নানা ছবিসহ আর্নে পেরাস লিখেছে, জ্বালানি স্বল্পতা ও প্রয়োজনের কারণে সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, এই যুক্তি দেখিয়ে যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।

আজ থেকে তিন দশক আগে জার্মানিতে আসার প্রথম দিন থেকেই গোরলেবেনের নামটি শুনতাম। আমার শহর হ্যানোভার থেকে আরও দেড় শ কিলোমিটার উত্তরের লবণ খনিসমৃদ্ধ এই অঞ্চলের গোরলেবেনে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য জমা করার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের কাছে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের প্রতীক হলো গোরলেবেন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য গোরলেবেনে জমা করবার প্রতিবাদে আশির দশকে এই অঞ্চলে শক্তিশালী পরিবেশবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনের হাত ধরেই পরবর্তী সময় পরিবেশবাদী গ্রিন দল জার্মানিতে আরও জনপ্রিয় হয় ওঠে।

এরপর ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ঘটল সেই সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ এখনকার ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লি দুর্ঘটনা। আরও পরে ২০১১ সালের মার্চে জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনা ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে যে অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতি, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জার্মানি তথা ইউরোপ থেকে পরিবেশবাদীরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে আরও সোচ্চার হওয়ার ফলে মানুষ ও জনপদ বিধ্বংসী প্রকল্প থেকে অনেক দেশ পিছিয়ে আসছে বা বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মিত রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া ফিরিয়ে নিতে সম্মত না হলে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হবে। কারণ, এই বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের একার পক্ষে বা বাংলাদেশের পানিবাহিত বদ্বীপ ভূগঠন প্রক্রিয়ার নরম মাটিতে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।

জ্বালানি উৎপাদনের ও উৎসের ক্ষেত্রে জার্মানি বা ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা যাবে না বটে, তবে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে অসুবিধা নেই। বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ, দেশকে এগিয়ে নিতে জ্বালানির আরও উন্নয়ন দরকার, তাই বলে নিসর্গ সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে বা নদনদী প্রবাহিত দেশে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, এটা কেমন যুক্তি?

পরিবেশ রক্ষার্থে কয়লা ও আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস করে বিকল্প জ্বালানির বিকাশ ও ব্যবহারে এই মুহূর্ত জার্মানি এক অগ্রগণ্য দেশ। বিগত দুই দশক থেকে জার্মানিতে সৌর, বায়ু বা পানিবিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত জ্বালানির হার ক্রমেই বাড়ছে। জ্বালানি খাতে জার্মানিতে একসময় কয়লা ও আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার হলেও পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে এই দুটি খাতনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থা থেকে ক্রমেই সরে আসছে তারা। পরিবেশের স্বার্থে জার্মান সরকার এর আগে ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের হার ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলেছে৷

জার্মানির অন্যতম জ্বালানি উৎপাদন কোম্পানি রাইনিখ (ভেস্টফ্যালিয়া ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশন বা আরডব্লিউই) সেই ১৯৭৪ সালে করা এক চুক্তির বলে রূঢ় অঞ্চলের হামবাখার ফ্রস্ট এলাকায় ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর বনভূমি এলাকায় উন্মুক্ত কয়লাখনি খননের অনুমোদন লাভ করে। চুক্তির চার বছর পর ১৯৭৮ সালে আরডব্লিউই কোম্পানি ওই এলাকায় উন্মুক্ত কয়লাখনির জন্য খননকাজ শুরু করে। চার বছর পর কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। এই মুহূর্তে এটি জার্মান সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদন কেন্দ্র।

জার্মানির নর্থরাইন ভেস্টফালেন রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি বলে রাইনিখ-ভেস্টফ্যালিয়া ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশন, হামবাখার ফ্রস্ট এলাকায় তাদের উন্মুক্ত কয়লাখনির পরিধি বাড়াতে গিয়ে এখন প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন। পরিবেশবাদীরা জলাভূমি সমৃদ্ধ হামবাখার অরণ্যের অসংখ্য বড় বড় বৃক্ষে অন্তত ৫০টি বৃক্ষঘর নির্মাণ করেছেন আর অনেকে বনভূমিতে তাঁবু নিয়ে অরণ্যেই ঘর বেঁধেছেন। পরিবেশবাদীদের দাবি অর্থনৈতিক লাভের জন্য প্রকৃতির সৃষ্টি এই নৈসর্গিক অরণ্য ধ্বংস করা যাবে না। সম্প্রতি আদালত ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের পক্ষে রায় দিলে, রাইনিখ-ভেস্টফ্যালিয়া ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি এই বনভূমি কাটতে উদ্যোগ নিয়েছে।

জার্মান সরকার গত ৬ জুন কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও কাঠামোগত বিষয় কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়াদি বিবেচনার জন্য কয়লা কমিশন গঠন করেছেন। জার্মান সরকারকে এই বছরের শেষের দিকে কয়লা কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেবেন। এর আগে জার্মানিতে আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি বন্ধের দাবিতে পরিবেশবাদীদের দীর্ঘদিনের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, জার্মান সরকার ১৭ আণবিক চুল্লি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ২০১১ সালে এথিক কমিশন গঠন করেছিলেন। আপাত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালে জার্মানির সব আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানি কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

জার্মানিতে কয়েক দশক আগে থেকেই পরিবেশবাদীদের চাপে রাজনৈতিক দলগুলো জ্বালানি ও পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পগুলো থেকে ক্রমেই সরে আসছে আর বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের যুক্তিকে রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন দলগুলো কোনো সময়ই আমলে নিচ্ছে না। বাংলাদেশে পরিবেশ মন্ত্রণালয় উন্নয়নের কথা বলে পরিবেশবিধ্বংসী আত্মঘাতী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছেন।

প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে পুলিশের হামলা ও তাদের বনভূমি থেকে জোর করে বিতাড়িত করে দেওয়ার বিষয়টি সপ্তাহজুড়ে জার্মানির সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়েছে। তবে একটি বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে হামবাখার ফ্রস্টের অরণ্য নিধন বন্ধ হয়েছে। একজন তরুণ সাংবাদিক বেশ কিছুদিন থেকেই হামবাখার অরণ্যে পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীদের প্রকৃতিপ্রেম এবং বৃক্ষরাজি বাঁচাতে বৃক্ষের ওপর ঘর বানিয়ে থাকার বিষয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করছিলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর এই সাংবাদিক বৃক্ষঘরগুলোর একটি থেকে ঝুলন্ত নড়বড়ে অস্থায়ী সেতু দিয়ে অপর বৃক্ষঘরে যাওয়ার সময়, পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে নর্থরাইন ভেস্টফালেন রাজ্য সরকার হামবাখার অরণ্যের নিধনপ্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করেছেন।

পৃথিবীর সর্বত্রই জীব বৈচিত্র্যময় বসুন্ধরা রক্ষার গুরুদায়িত্ব স্ব-স্ব অঞ্চলের মানুষের । বাংলাদেশের প্রকৃতি আর পরিবেশপ্রেমীরাও দীর্ঘদিন থেকে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে বলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থানান্তরের জন্য বা রূপপুর পারমাণবিক চুল্লির বর্জ্য শেষ পর্যন্ত কোথায় রক্ষিত হবে, তা নিয়ে আন্দোলন করছেন। জার্মানির হামবাখার অরণ্যে একটি করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অরণ্য বাঁচাতে প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবাদীদের আপাত জয় হয়েছে। তারপরও পরিবেশবাদীদের নিরন্তর আন্দোলন সংগ্রাম জার্মানির পরিবেশবান্ধব জ্বালানিনীতি বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]