৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হবে না

>

চলমান রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধি। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল। এখানে ড. মাকসুদ কামালের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম। 

প্রথম আলো: একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের অনেক কৌতূহল। কেউ ভাবছেন নির্বাচন হবে কি না, হলে কী পদ্ধতিতে হবে, সুষ্ঠু হবে কি না, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে কি না। অনেকেই চিন্তিত যে কী হবে। আপনি কি চিন্তিত?

এ এস এম মাকসুদ কামাল: আমি তেমন চিন্তিত নই। অতীতেও এ রকম সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেসব সংকট কেটেও গেছে।

প্রথম আলো: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি সংকট বলে মনে করছেন?

মাকসুদ কামাল: যেহেতু বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছে এবং রাজপথে নেমেছে, অন্যদিকে সরকারেরও একটা অবস্থান আছে, সেহেতু এটা এক অর্থে রাজনৈতিক সংকটই বটে। তবে এ রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতেও সৃষ্টি হয়েছে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। আমার মনে হয়, এবারও সরকার ও বিরোধী দলগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছাবে।

প্রথম আলো: অতীতে কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন সব সময় সম্ভব হয়নি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন একটা দৃষ্টান্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটা সরকারের মেয়াদ শেষ হলে শান্তিপূর্ণভাবে সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে এবং জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারা সরকার গঠন করবে। এই যে পিসফুল ট্রান্সফার অব পাওয়ার—এই ব্যবস্থা আমাদের দেশে গড়ে উঠল না। কেন একটা সরকারের মেয়াদ শেষ হলে দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন হতে হয়—নির্বাচন কীভাবে হবে?

মাকসুদ কামাল: এর মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে নানা কারণে। একটা কারণ ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডও একটা বিষয়। পরবর্তীকালে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা একটা বিরাট ক্ষত সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির হস্তক্ষেপের কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। পারস্পরিক আস্থাহীনতাই প্রকট হয়ে উঠেছে।

প্রথম আলো: সেই আস্থার সংকট নিয়েই আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছি। এখন কী হবে?

মাকসুদ কামাল: যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবে, তাদের ওপর আস্থা রেখে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী হতে হবে, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র নির্বাচন কমিশনকেই প্রস্তুত করতে হবে। এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সব সরকারের আমলেই বিরোধী দলগুলো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলে, অনাস্থা প্রদর্শন করে। কিন্তু কোনো একটা পয়েন্টে এসে তো আমাদের সবাইকে একমত হতেই হবে, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য।

প্রথম আলো: সরকার যদি তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে চায় এবং বিরোধী দলগুলো যদি সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটলই থেকে যায়, তাহলে কী হবে?

মাকসুদ কামাল: আমার ধারণা, সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা হবে, বিরোধী দলগুলো বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং সরকারের উচিত হবে সে ধরনের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ সরকারের আওতায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উপযোগী একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

প্রথম আলো: গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার আগে তো নির্বাচনটা হতে হবে। আপনার কি মনে হয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল পরিবেশ এখন আছে?

মাকসুদ কামাল: আমার মনে হয় না সেই পরিবেশ থেকে দেশ খুব একটা বিচ্যুত হয়েছে।

প্রথম আলো: সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অভিযোগ করে, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হয় না, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, অনেককে গ্রেপ্তার-আটক করা হয়েছে, তাদের নেতা-কর্মীরা ব্যাপক দমনপীড়নের শিকার। এটাকে কি তাদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ বলা যায়?

মাকসুদ কামাল: আমার মনে হয়, দেশের মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রথম আলো: কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিতে হলে তো তাদের নির্বাচন পর্যন্ত যেতে হবে।

মাকসুদ কামাল: নির্বাচন পর্যন্ত যাওয়াও সম্ভব হবে। সরকার বিরোধী দলকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে, তারা সে সমাবেশ করেছে। এই অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমার মনে হয়েছে যে সরকারের ভেতরেও এই উপলব্ধিটা আছে যে সকলে মিলেই নির্বাচনটা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, এভাবেই নির্বাচন হবে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো একটা পর্যায়ে এসে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করে। অতীতে আমরা এটা দেখেছি যে সংকটের শেষ মুহূর্তে গিয়ে সবাই একটা উপলব্ধিতে পৌঁছান। কিন্তু যে সংস্কৃতি আমরা এখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, সেটা হলো নির্বাচনের পরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা।

প্রথম আলো: সব দলকে নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হবে—আপনার এই আশাবাদ সত্য হলে খুব ভালো। কিন্তু তা যদি না হয়, তাহলে কি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটা নির্বাচন হবে? সরকার সেটা করতে চাইলে তা করতে পারবে?

মাকসুদ কামাল: আমার মনে হয় না ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হবে। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, অনেকে তা পালন করেননি। জনগণ নির্বাচনে ভোট দিতে চেয়েছে, কিন্তু অনেকে নির্বাচনে আসেননি। বিএনপির উচিত ছিল নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তারপর যদি কিছু ঘটত, তাহলে তারা সেটা বলতে পারত, জনগণ সেটা শুনত। কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশই নেয়নি, বরং সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, ব্যাপক সহিংসতা করেছিল। এসব না করে তারা যদি নির্বাচনে যেত, ভোটযুদ্ধের মাঠে থাকত, তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, এ রকম অভিযোগ যদি তারা উত্থাপন করতে পারত, তাহলে হয়তো আরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারত।

প্রথম আলো: আপনি কিছুক্ষণ আগে বলেছেন, আমাদের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কি শক্তিশালী বলে আপনার মনে হয়?

মাকসুদ কামাল: নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে যদি কারও কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তবে তারা সেটা উত্থাপন করতে পারে...

প্রথম আলো: আপনার নিজের কী মনে হয়? এই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে?

মাকসুদ কামাল: সেটিও রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপার...

প্রথম আলো: আপনার কী মনে হয়?

মাকসুদ কামাল: নির্বাচন কমিশন একটি প্রতিষ্ঠান, এটি কোনো ব্যক্তির নয়। প্রতিষ্ঠানের যে আইনকানুন আছে, যেসব দায়িত্ব-কর্তব্য আছে, সেগুলো যদি সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালন করা সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব।

প্রথম আলো: বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা একটা ঐক্য প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি, যেখানে ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখ আছেন। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মাকসুদ কামাল: নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হতে পারে, নির্বাচনী জোট হতে পারে। অতীতে হয়েছে, এবারও ঐক্য প্রক্রিয়া চলছে বলে আমরা সংবাদমাধ্যমে জানতে পারছি। আমি এই ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে খারাপ কিছু দেখি না। ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে যাঁরা আছেন এবং এর বাইরে আছেন, শুধু জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে সবাই মিলে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। জনগণ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাকসুদ কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।