হায় ইয়েমেন, হায় মানবসভ্যতা!

প্রতিনিয়তই এভাবে শিশুদের জন্য কবর খুঁড়তে হচ্ছে জীবিত ইয়েমেনিদের। ছবি: এএফপি
প্রতিনিয়তই এভাবে শিশুদের জন্য কবর খুঁড়তে হচ্ছে জীবিত ইয়েমেনিদের। ছবি: এএফপি

ইয়েমেনে মানবসভ্যতার পতন ঘটেছে—এ কথা বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেল খুললেই চোখে পড়ে ইয়েমেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়িঘর। হাড়জিরজিরে অপুষ্ট শিশুদের ছবি। অনাহারক্লিষ্ট ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। নানা পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানবসভ্যতার এক ভয়াবহ বিপর্যয় আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এক নীরব গণহত্যার সাক্ষী হচ্ছি আমরা। সাম্প্রতিক সংকটে ইয়েমেনে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী ও শিশু। যদিও এই যুদ্ধে নারী ও শিশুদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। থাকার কথাও না। পৃথিবীর কোনো যুদ্ধই নারী ও শিশুরা শুরু করে না। আধিপত্যবাদীদের সৃষ্ট এই ভয়াবহ দুর্যোগের কারণে ইয়েমেনে মহামারি আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে ইয়েমেনের সাধারণ নাগরিক। ৮০ শতাংশ মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা নেই। সৌদি অবরোধে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহও বন্ধ। সাত মিলিয়নের বেশি মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছে।

কয়েক বছর ধরেই ইয়েমেনের মানুষ ভালো নেই। পরিস্থিতি অনুসারে ভালো থাকার কথাও না। একদিকে হুতিদের আক্রমণ, অন্যদিকে সৌদি আরবের বর্বরোচিত বিমান হামলা। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে আল–কায়েদার জঙ্গি তৎপরতা। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্মম খেলার স্থানে পরিণত হয়েছে ইয়েমেন। আমেরিকা, রাশিয়া, ইরান, চীন ও সৌদি আরব নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য ইয়েমেনের সরকার, হুতি বিদ্রোহী, দক্ষিণের স্বাধীনতাকামী ও জঙ্গিদের সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু ইয়েমেনের জনসাধারণের কথা কেউ বিবেচনা করছে না। নির্মমতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে সৌদি আরব। সৌদি শাসকদের দেখে আরবের প্রাচীন নির্দয় শাসকদের কথা মনে পড়ে যায়।

মার্কিন সহায়তাপুষ্ট সৌদি আরব শুধু সামরিক হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি; ইয়েমেনের জল ও আকাশসীমায় অবরোধও আরোপ করেছে। আমরা সভ্য জগতের সুবিধাভোগীরা ইয়েমেনিদের দুর্দশা দেখছি। আর উহ্‌–আহ্‌ করছি। জাতিসংঘ মানবতার ভয়াবহ বিপর্যয় হচ্ছে বলে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব পালন করছে। সৌদি হামলা ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়ায় সিভিলিয়ানদের রক্ষায় জাতিসংঘ তৎপরতা অতীতে আমরা যতটা দেখেছি, ইয়েমেনের বেলায় কিন্তু তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। ইয়েমেনি নারী ও শিশুদের রক্ষায় সারা বিশ্বই অনেকটা উদাসীন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কোনো কারণে যদি পাশার দান উল্টে যায়, ভবিষ্যতে দেখা যাবে, এই সৌদি শাসকদেরই গণহত্যার বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদালতে। মার্কিনদের তখন সৌদি আরবের পাশে পাওয়া যাবে না। বসনিয়ার সেব্রেনিতসা গণহত্যার সময় সারা বিশ্ব দেখেও না দেখার ভান করেছে। পেন্টাগনে বসে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা স্যাটেলাইটে হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। বলা হয়ে থাকে, মার্কিনদের মদদেই সার্বিয়া এই গণহত্যা পরিচালনা করে। এরপর সার্বিয়ান জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে যখন হেগের আদালতে বিচার চলছে, মার্কিনরা তখন মানবতার সব থেকে বড় ঠিকাদার। এটাই মার্কিনদের সুবিধা। এঁরা সব পক্ষেই থাকেন।

সৌদি অবরোধে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিও নিয়ে নিচ্ছে শিশুদের। ছবি: এএফপি
সৌদি অবরোধে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিও নিয়ে নিচ্ছে শিশুদের। ছবি: এএফপি

ইয়েমেনের সংকটের শুরু ২০১১ সালে আরব বসন্ত থেকে। আরব বসন্তের ধাক্কায় সৌদিপন্থী শাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহর পলায়ন এবং ইরানপন্থী শিয়া হুতিদের রাজধানী সানা দখল ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। আবদুল্লাহ সালেহর পতনের পর তাঁর ডেপুটি মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু মনসুর হাদির বিরুদ্ধে হুতিদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণের বিদ্রোহীরা স্বাধীনতার জন্য নড়াচড়া শুরু করে। ২০১৪ সালে হাদিকে বের করে দিয়ে সানার দখল নেয় হুতিরা। আল–কায়েদাসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীও ইয়েমেনে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই ইয়েমেনের সংকট জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। এরপর ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ আর অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ক্রমেই আঞ্চলিক লড়াই থেকে আন্তর্জাতিক আবহ লাভ করে। ইয়েমেন মূলত মার্কিন ও ইরানিদের যুদ্ধ চলছে। মার্কিনের পক্ষে প্রক্সি দিচ্ছে সৌদি আর হুতিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে ইরান। মাঝ থেকে দুর্দশায় পড়েছে সিভিলিয়ানরা।

ইয়েমেনের এই আপাত–বহুজাতিক লড়াইয়ের মূল কারণ হচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তার করা। আরবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে লড়াই এখন প্রকাশ্য। ইরান যদি ইয়েমেনে নিজস্ব বলয়ের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে, তবে সহজেই এডেন সাগর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সৌদি আরবের একেবারে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলতে পারবে ইরান। ইয়েমেনের লড়াইয়ে ইরানকে পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া ও চীন। চীনের লক্ষ যদি হয় বাণিজ্য, তবে রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করা। চীন এডেন বন্দরকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় বাণিজ্যিক কারণে। ইরান ও রাশিয়ার উদ্দেশ্য সামরিক। অন্যদিকে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করছে আরবে ক্রমবর্ধমান রাশিয়া ও ইরানের প্রভাবকে প্রতিহত করতে। ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি কেবল শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ না; একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হচ্ছে।

সবকিছু মিলে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে নানা দল লড়াই করছে। সৌদি সমর্থন পুষ্ট ইয়েমেনের সরকারকে ত্রিমুখী আক্রমণ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইরানের সহায়তাপুষ্ট শিয়া হুতিগোষ্ঠী, দক্ষিণের স্বাধীনতাকামী ও ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী। সরকারবিরোধী তিন পক্ষ আবার নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। হুতিদের ওপর সৌদি জোট যেমন হামলা করছে; আবার হুতি বিদ্রোহীরাও সৌদিকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়ছে। হুতিরা সরকার–সমর্থক অনেককেই অপহরণ করে হত্যা করছে।

বস্তুত, ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ এক নিদারুণ সময় অতিবাহিত করছে। কিন্তু ইয়েমেনের সংকট মনে হয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। সবাই ফিলিস্তিন বা সিরিয়ার সংকট নিয়ে যেভাবে কথা বলছে, ইয়েমেনের যুদ্ধ নিয়ে সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না। ফিলিস্তিন বা সিরিয়া নিয়ে অবশ্য কথা হবে। কিন্তু আমাদের ইয়েমেনিদেরও মনে রাখতে হবে। ক্ষুধায়, বোমায়, গুলিতে ইয়েমেনিরা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে না।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।