শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি কি বন্ধ হবে না?

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অহেতুক ভোগান্তি থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। ফাইল ছবি
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অহেতুক ভোগান্তি থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। ফাইল ছবি

গণিত অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা কিংবা তারুণ্যের জয়োৎসবের কারণে আমাকে সারা দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। দেখা হয় হাজার হাজার ছেলেমেয়ের সঙ্গে, যারা নিজেদের দারুণ ভবিষ্যৎ রচনা করতে চায়, দেশকেও পাল্টে দিতে চায়। আয়োজনগুলোর বেশির ভাগই স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। ফলে ওরা যখন এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করে, তখনো ওদের ও ওদের মা–বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়। ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রাঙ্গণে দেখা হয়েছে আমার কলেজজীবনের বন্ধু এক চিকিৎসক দম্পতির সঙ্গে। তাঁরা আগের দিন মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন, পরীক্ষা শেষে বিকেলের ট্রেনে চট্টগ্রাম চলে যাবেন। বুয়েট কর্তৃপক্ষ রাস্তায় শামিয়ানা টাঙিয়ে, চেয়ার পেতে দিয়েছে যাতে অভিভাবকেরা অপেক্ষা করতে পারেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা কজন অভিভাবক বললেন, তাঁরা রাতের বাসে এসেছেন। কারণ ঢাকায় তাঁদের রাতে থাকার জায়গা নেই। পরীক্ষার পর সেদিনই ফিরে যাবেন। প্রায় ১২ হাজার পরীক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। প্রত্যেকের সঙ্গে এক–দুজন করে অভিভাবক রয়েছেন। যাঁরা ভাবছেন দৃশ্যটি খুবই স্বাভাবিক, তাঁরা ঠিক এর দুদিন আগের আরও একটি পরীক্ষার কথা ভাবতে পারেন।

৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম, খুলনা বা বরিশাল থেকে কাউকে কিন্তু ঢাকায় আসতে হয়নি। সারা দেশের ১৯টি কেন্দ্রের ২৭টি স্থানে তারা পরীক্ষা দিতে পেরেছে। শুধু তা–ই নয়, রংপুরে পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে কারও কোনো অসুবিধা হয়নি। এক পরীক্ষাতেই ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিপুলসংখ্যক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

মেডিকেলে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের হয়রানি এভাবে কমেছে। কিন্তু অন্যদের ভোগান্তি চলছেই। যেমন, দেশের ৫টি সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটিতেই আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। একসময় দুটি দিলেই হতো। কুয়েট, রুয়েট ও চুয়েট প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার আগে ছিল প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (বিআইটি)। এগুলোর ভর্তি পরীক্ষা হতো একসঙ্গে এবং একটি মাত্র পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা খুলনা, রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিআইটিতে ভর্তি হতে পারত। কিন্তু বিশ্ব যতই এগোয়, আমরা ততই পেছাতে থাকি। তাই তিন দশক আগের ছেলেমেয়েরা যে সুযোগ পেত, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা পায় না। ওই তিন বিআইটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর থেকে এখন আলাদাভাবেই ভর্তি পরীক্ষা নেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা–ই। দেশে বর্তমানে ১৩১টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনশর বেশি বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ১৯৮০–এর দশকের শেষভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউনিটভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু হয়। তার আগে বিভাগওয়ারি ভর্তির পদ্ধতি ছিল। এখনো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যবস্থা চালু আছে। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে কখনো কখনো বাক্স-পেটরা নিয়ে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য অন্য এক শহরে স্থানান্তরিত হতে হয়।

রংপুরের এক মা এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে আছেন কোচিংয়ের জন্য। মেয়ে ৫ অক্টোবর মেডিকেল পরীক্ষার পর বুয়েটে পরীক্ষা দিয়েছে ৭ অক্টোবর। ১২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে মা-মেয়ে পরদিন ভোরে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে উড়ে যাবেন সিলেটে। কারণ, ১৩ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। সেদিন সিলেট শহরে থাকার কোনো হোটেল পাওয়া যাবে না, অনেককেই আগের রাতে রেলস্টেশনে থাকতে দেখা যাবে।

এটা শুধু এক মা ও তাঁর মেয়ের অভিজ্ঞতা নয়। এঁদের সংখ্যা কয়েক লাখ। কিছু লোকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, মূঢ়তা ও লোভের ফলে ছেলেমেয়েরা মা–বাবাদের সঙ্গে এক শহর থেকে আরেক শহরে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে।  

আছে ভর্তি পরীক্ষার খরচ। একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি পরীক্ষার ফরমই কিনতে হচ্ছে না, বিস্তর ছোটাছুটির খরচও বহন করতে হচ্ছে। ছাত্রীদের খরচ বেশি, কারণ তাদের শহর থেকে শহরে ছুটে বেড়ানোর জন্য অভিভাবকদের কাউকে সঙ্গে নিতে হচ্ছে।

অথচ সামান্য উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। কাজটা শুরু করতে পারে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাদের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি কমবেশি একই রকম। সংশ্লিষ্টরা নিজেরা বসে এটিকে সহজেই একটি সিস্টেমের আওতায় আনতে পারবেন। এ পদ্ধতিতে একই দিনে, একই প্রশ্নপত্রে কুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় স্থান নিয়ে একজন শিক্ষার্থী সহজে বুয়েটে বা চুয়েটে ভর্তি হতে পারবে। এর পরের বছরগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুষদভিত্তিক পদ্ধতি চালু করে ফেলা সম্ভব হবে।

এই প্রস্তাবে যাঁরা আপত্তি করতে পারেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা এই ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে। পাশের দেশের আইআইটি, এনআইআইটি, আইআইআইটিগুলোর ভর্তি পরীক্ষার এই সমন্বিত ব্যবস্থার বয়স ৫০ বছর পেরিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আমাদের মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, কিন্তু গত কয়েক বছরে এমন কিছু হয়নি। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে এগুলো কোনো সমস্যা নয়।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এসব অহেতুক ভোগান্তি, অর্থব্যয় ও সময়ের অপচয় থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দায়িত্বশীল মহল এ বিষয়ে কিছু ভাবে কি না কে জানে। অবশ্য এটা কারও কারও কাছে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা আদায়ের একটা পথ। তা ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। তারা তো সরকার নয় যে, ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে তাদের দিয়ে একটি ভালো কাজ করিয়ে নেবে।

তারা প্রতিবছর লাখ লাখ ছেলেমেয়ে আর তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি দেখে মনে মনে ভাববে, ‘হু, আমরা হার্ভার্ড কিংবা এমআইটি থেকেও বড় বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ক্যাম্পাসে, আমাদের নিজেদের প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে আমরা কাউকে ভর্তি করি না।’

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক