আরেকটি মন্দার দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব অর্থনীতি!

সারা বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই একটি নতুন বিন্যাসের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাণিজ্য সুরক্ষা ও সম্প্রসারণের নানা কৌশল দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন মেতে উঠেছে বাণিজ্যযুদ্ধে, অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বহুপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর পুনর্বিন্যাস দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বড় শক্তিগুলোর এই লড়াই ও পুনর্বিন্যাসের মধ্যেই আর্জেন্টিনা, তুরস্কের মতো দেশগুলো যাচ্ছে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে।

বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা এক বছর আগেও বেশ চাঙা ছিল। ২০১৭ সালজুড়ে এক ব্রিটেন ছাড়া বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সবাই উচ্চ প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে ব্যাপক অগ্রগতি, মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে চীন, এমনকি হাজার সংকটের মধ্যেও ইউরোপও এগিয়ে গেছে। কিন্তু ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে এ বিশ্ব অর্থনীতি যেন হঠাৎ করেই উল্টো বাঁক নিয়েছে। গত সপ্তাহে সারা বিশ্বের সব কটি শেয়ারবাজার দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। ধীর প্রবৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মুদ্রানীতিকে এর কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি সূচকের মান ১০ অক্টোবর ৩ পয়েন্ট কমেছে, যা গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধস। সাংহাই শেয়ারবাজারের অবস্থা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে নড়বড়ে। এমনকি হংকং ও জাপানের শেয়ারবাজারের ধস নেমেছে সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি। এই যখন অবস্থা, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হবে। আইএমএফের আগের পূর্বাভাসে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু বছর শেষ হওয়ার আগেই এ পূর্বাভাস সংশোধন করতে হলো সংস্থাটিকে।

এমন নয় যে চলতি বছর একটা বড় ধস নেমে এসেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ঠিকঠাক বলতে গেলে, এখনো বৈশ্বিক অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু শঙ্কা তৈরি করেছে বিদ্যমান প্রবণতা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এখনো বড় অর্থনীতির দেশগুলোয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি দৃশ্যমান থাকলেও তার ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একেক অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবণতা একেক রকম। যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর পুনর্গঠনের কারণে সর্বশেষ প্রান্তিকে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে। দেশটির বেকারত্বের হার বর্তমানে ১৯৬৯ সালের পর সর্বনিম্ন। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আইএমএফ মনে করছে, বিশ্বের সব কটি বড় অর্থনীতির দেশে প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হবে। একই সঙ্গে সংকট দেখা দেবে চীন ও ভারতের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য শক্তিশালী দেশগুলোর এই ভিন্নতাকেই বিশ্লেষকেরা শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখছেন। ইকোনমিস্টের মতে, মুদ্রানীতির পার্থক্যের কারণেই এই ফারাক তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আটবার সুদহার বাড়িয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। অথচ ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) এখনো একবারও এমন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাপানে সুদহার এখনো ঋণাত্মক। আর অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবণতা রোধ করতে চীন মাত্র গত সপ্তাহেই মুদ্রানীতি শিথিল করেছে।

বিশ্লেষকেরা মুদ্রানীতির এই ফারাককেই বড় শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র একাই শুধু সুদহার বাড়ানোর কারণে অন্য মুদ্রার তুলনায় ডলারের শক্তি বেড়েছে। ফলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে ডলারে নেওয়া ঋণ পরিশোধ অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে সংকটে পড়েছে আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক। তুরস্কের মুদ্রার দাম ভয়াবহভাবে কমেছে। দেশটি এখন স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চার আরব দেশের অবরোধে নাকাল কাতার এ অবস্থায় দেশটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দিয়ে বিপদে বন্ধুর পরিচয় দেওয়া তুরস্কের পাশে দাঁড়াচ্ছে কাতার। একইভাবে ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়া আর্জেন্টিনা অকূলপাথারে কূল খুঁজে মরছে। আর সদ্যই দায়িত্ব নেওয়া ইমরান খানের সরকার পাকিস্তানকে বাঁচাতে আইএমএফের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঋণ মওকুফ চেয়েছে।

এই অবস্থার মধ্যে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা। বিশেষত চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ দিনকে দিন তীব্র হচ্ছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। ফোর্বস জানাচ্ছে, আইএমএফ যে নতুন পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কারণ হিসেবে এ বাণিজ্যযুদ্ধকে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও নানা ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা সম্ভাব্য বাণিজ্য-বাধা ও জ্বালানি তেলের বাজারে ঊর্ধ্বগতি নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু তারপরও বিনিয়োগে বড় ধরনের নেতিবাচক কিছু এখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়।

ইরান ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ বাণিজ্য–লড়াই চালিয়ে গেলে ২০১৯ সাল সারা বিশ্বের অর্থনীতির জন্যই বেশ কঠিন এক পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ফোর্বস। পত্রিকাটির মতে, এই পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না বিনিয়োগকারীদের পক্ষে; তেমনটি হওয়া উচিতও নয়।

বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান প্রবণতায় দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষে রয়েছে উন্নত ও ধনী দেশগুলো; অন্য পক্ষে রয়েছে চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারতসহ দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিগুলো। এই দুটি পক্ষই এখন অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি দেশই নানা ভূরাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্ব শাসনের সমীকরণে নিজের ভাগ বুঝে নিতে সবাই তৎপর। এত কিছুর মধ্যেও একটা সুসংবাদ হচ্ছে ২০০৮ সালের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবস্থা বেশ ভালো। ফলে, এক দশক আগের মতো সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু দুঃসংবাদটি আসছে বাণিজ্যযুদ্ধ অনুসরণ করেই। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এ লড়াইয়ের প্রভাব এখনো যথেষ্ট অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যদি আরেকটি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলেই এর প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। কারণ, বড় অর্থনীতির দেশগুলোর কারোরই তেমন কোনো প্রস্তুতি এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

ইকোনমিস্টের মতে, আরেকটি মন্দার জন্য ধনী দেশগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। আগের মন্দা কাটিয়ে ওঠার পন্থা হিসেবে নেওয়া মুদ্রানীতি থেকে এখনো সরে আসেনি দেশগুলো। মন্দার সময়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করে অর্থনীতি চাঙা করার জন্য সুদহার কমানোর সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ। ইউরো ও জাপানের মতো অঞ্চলে এ সম্ভাবনা নেই একেবারে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও এমন যে তা এই পরিস্থিতিতে সুদহার কমানোর একাধিক পদক্ষেপ নিতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অর্থায়নের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ যেকোনো ধনী দেশে বড় ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে পারে। বাড়তি ঝুঁকি হিসেবে রয়েছে বিভাজনের রাজনীতি। কট্টর জাতীয়তাবাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী বেশ জোরেশোরে। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আগের চেয়ে বর্তমানে বেশি দূরত্বে অবস্থান করছে। ফলে, এক দশক আগে যে সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে মন্দা কাটিয়ে ওঠা গেছে, তার সুযোগ এবার সংকুচিত হয়েছে।

সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি আরেকটি মন্দার ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বিশ্বের শক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বাজার ও প্রভাববলয় বৃদ্ধির নতুন সমীকরণ। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব এ সংকট মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে চলমান এ দ্বন্দ্বের রাশ বিশ্বনেতারা টেনে ধরতে না পারলে গত দশকের মতোই আরেকটি মন্দা দেখতে হতে পারে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা।