ধনী তৈরির কারখানা

সুখবরটা এত দিনে নিশ্চয়ই আপনাদের কানে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের এক নম্বর ধনী তৈরির কারখানা। ঠাট্টা নয়, বিলাতের ওয়েলথ এক্স ইনস্টিটিউট নামের এক গবেষণা সংস্থা বিস্তর তথ্য-প্রমাণসহ হিসাব করে দেখিয়েছে, বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে বাংলাদেশে। এই ধনীদের একটা পোশাকি ইংরেজি নামও রয়েছে—আলট্রা হাই নেট ওয়ার্থ ইনডিভিজুযয়ালস, সংক্ষেপে ইউএইচএনডব্লিউআই।

বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে যাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা আড়াই শ কোটি টাকা, তাঁরাই এই ইউএইচএনডব্লিউআই হিসেবে বিবেচিত হবেন। বিশ্বে অতি ধনী মানুষের অভাব নেই, মোট সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন এখনো আমাদের অনেক ওপরে। কিন্তু যে গতিতে আমরা ধনী তৈরি করছি, তাতে আমরা এদের সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছি। বস্তুত, আলট্রা এক্স ধনী তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা যে ১০টি দেশ চিহ্নিত করেছে, তার ১ নম্বরে বাংলাদেশ। আর ১০ নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র।

আলট্রা এক্স জানিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৭—এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অতি ধনী বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। অথচ একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অতি ধনী বৃদ্ধির হার মাত্র ৮ শতাংশ। এই তালিকায় দুই নম্বরে রয়েছে চীন, পাঁচ নম্বরে ভারত, নয় নম্বরে পাকিস্তান।

ওয়েলথ এক্স ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভিনসেন্ট হোয়াইট স্বীকার করেছেন, এই তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশের নাম দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। দেশটা এখনো অতি দরিদ্র, তার মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৭৯১ ডলার (যেখানে আমেরিকার ৫৭ হাজার ডলার)। কিন্তু কথা সেখানে নয়। ভিনসেন্ট বলেছেন, বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে আশ্চর্য রকম উন্নতি করেছে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে অন্য অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। ধনী সৃষ্টির ম্যাজিকটা সেখানেই। ভিনসেন্ট অবশ্য স্বীকার করেছেন, এই প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সব মানুষ সমানভাবে লাভবান হয়নি, হাতে গোনা কয়েকজন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অতি ধনী ৮০ হাজার জন, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৫৫ জন।

এই সংখ্যা দেখে হতাশ হওয়ায় আমার এক বন্ধু আশ্বাস দিলেন, বাংলাদেশে যে হারে কলাগাছ বাড়ছে, অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, তাতে খুব শিগগির দেশে আর শুকনো আঙুল থাকবে না। মায় আমার শুকনো আঙুলও! কথাটা সত্যি হলে খুশি হতাম, কিন্তু বাস্তব কিছুটা রূঢ়। বাংলাদেশে মোট সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে আসল ফায়দা পাচ্ছে এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের মালিক। গত ৫-৬ বছরে তাদের মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশের মালিক। গত ৫-৬ বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ তো বাড়েইনি, বরং কমেছে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব হচ্ছে আরও গরিব।

আমেরিকায় বলা হয়, বড়লোক যদি আরও বড়লোক হয়, তাহলে গরিবদেরও লাভ। কারণ, এক মুঠোয় যত টাকা ধরা যায়, তার বেশি যদি ধনীরা মুষ্টিবদ্ধ করে, তাহলে বেশ কিছু সিকি-আধুলি তাদের আঙুল গলিয়ে মাটিতে পড়বে। আর সে পয়সা পাবে ওই গরিবেরা। এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কী হতে পারে!

অনুমান করি, যাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ঊর্ধ্বগতিতে ডুগডুগি বাজাচ্ছেন, তাঁরাও সম্ভবত এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। খুব দায়িত্বসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তির কাছে আমি শুনেছি, বাংলাদেশে এখন এত উন্নতি হয়েছে যে খালি গায়ে বা খালি পায়ে লোক আর দেখতেই পাওয়া যায় না। উন্নতির মানদণ্ডটি যদি এত নিচু হয়, তাহলে মানতেই হবে আমরা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছি।

রাজনীতিবিদেরা এই মানদণ্ডে খুশি হতে পারেন। আমাদের হওয়া উচিত নয়। উন্নয়নের ফসল যাতে সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায়, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তেমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কাজ ফুরালে পাজি, আমাদের সব ক্ষমতাধর কাজির অবস্থা সেই রকম। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, এমন প্রতিটি সরকারে আমরা দেখেছি ক্ষমতার আশপাশে রয়েছে, এমন মানুষেরাই লাভবান হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ওই যে ১৭ শতাংশ হারে অতি ধনী বাড়ছে, এরা সবাই ক্ষমতার নিকটবর্তী সেই সব মানুষ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই অতি ধনীদের অধিকাংশই তাদের মুষ্টিবদ্ধ অর্থ দেশে না রেখে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হাত চুইয়ে তার কিছু গরিব-গুরবো চেটে খাবে, তারও উপায় নেই।

বাংলাদেশ যে সত্যি সত্যি ধনী তৈরির কারখানা হয়ে উঠছে, সে কথা আমরা গত বছরেই টের পেয়েছিলাম ‘পানামা পেপারস’–এর বদৌলতে। পানামার মোসাক ফনসেকা নামে এক অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, যারা পৃথিবীর অতি ধনীদের পাচার করা অর্থ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত, তাদের ফাঁস হওয়া নথিপত্র থেকে জানা গেল, বাংলাদেশের অন্ততপক্ষে ২৫ জন ব্যক্তি, যাঁরা নিজেদের অতি কষ্টে অর্জিত অর্থ নিজের দেশে রাখার বদলে সঙ্গোপনে দেশের বাইরে পাচার করেছেন, এই কোম্পানি সেই অর্থ অতি যত্নে পাহারা দিয়ে চলেছে। পানামা পেপারসের তালিকায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী, মন্ত্রীর ভাই বা স্ত্রী।

এক হিসাবে দেখছি, ২০০৫-২০১৪, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এমন অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার। বলাই বাহুল্য, যারা এই অর্থ পাচার করে, তারা প্রায় সবাই ওই ইউএইচএনডব্লিউআই। বিদেশে কী করে অর্থ পাচার করে, সে হিসাব আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠিনি। শুনেছি, এর প্রধান অস্ত্র নাকি ‘আন্ডারইনভয়েসিং’। বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশে অর্থ প্রেরণের ব্যাপারে নানা রকম আইনকানুন করেছে। তারপরও এত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কী করে বিদেশে পাচার হচ্ছে, তা আল্লাহ মালুম।

বিদেশে পাচার করা এই অর্থ প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যয় হয় বিদেশে মস্ত দামে আলিশান ঘরবাড়ি কিনতে। এই অর্থ দিয়েই কানাডার টরন্টোতে গড়ে উঠেছে বেগম পাড়া। অথবা নিউইয়র্কে একই বিল্ডিংয়ে এক মালিকের রয়েছে ডজনখানেক অ্যাপার্টমেন্ট।
বাংলাদেশ ধনী তৈরির কারখানা হোক অথবা অর্থ পাচারের স্বর্গরাজ্য হোক, এর কোনোটাই আমরা চাই না। আমরা চাই সম্পদ বাড়ুক, কিন্তু সেই সম্পদের বণ্টন অধিক সুষম হোক। এই বণ্টনের পক্ষে অর্থনীতিবিদ পিটার সিঙ্গার ‘নৈতিক সমতার’ যুক্তি দেখিয়েছেন। যেকোনো সভ্য সমাজের একটি প্রাথমিক পূর্বশর্ত হলো মানুষমাত্রই গুরুত্বপূর্ণ, সমাজ কাউকেই পেছনে ফেলে রাখবে না, এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে রয়েছে একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি।

কিন্তু শুধু নৈতিক সমতার জন্য নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থেই প্রয়োজন সম্পদের অধিক সুষম বণ্টন। বৈষম্যের কারণে যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে, তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাব্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। এর ফলে কাগজে–কলমে ক্ষতি হয় দেশের গরিব মানুষের, কিন্তু আসলে ঠকে পুরো দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক হিসাবে দেখিয়েছে, দেশের ভেতরে অসাম্য যদি মাত্র ১ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে গড় মোট জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থের অঙ্কে এবং দীর্ঘমেয়াদি হিসাবে এর পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

আমরা যদি ধনী তৈরির কারখানা বানানোর বদলে সবার কাছে উন্নয়নের সুবিধাগুলো পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলে দেশটা কী অবাক রকম বদলে যেত!

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি