নতুন সন্ধিক্ষণে আজকের চ্যালেঞ্জ

গত শনিবার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট
গত শনিবার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

দেশের রাজনীতিতে একটা ঘোলাটে পর্বের সূচনা হচ্ছে বলে মনে হয়। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না যে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন, তাতে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি নেই। তা ছাড়া, জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত দল নয় বলে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু জামায়াত বিলুপ্ত হয়ে গেছে—এমন কথা বলা যাবে না। বিএনপির নেতৃত্বে পৃথক যে নির্বাচনী জোট রয়েছে, তাতে জামায়াত দ্বিতীয় শক্তি। সম্ভবত ভোটের হিসাবে জামায়াতের অবস্থান হবে জাতীয় পার্টির পরে, অর্থাৎ চতুর্থ।

ড. কামাল ও অন্যরা বলছেন এটি নির্বাচনী জোট নয়, আগামী নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচনটি সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু করার দাবি নিয়েই তাঁরা আন্দোলনে নামছেন। তাঁদের এই ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্য ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দাবিগুলো অনেকাংশে নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং লক্ষ্যগুলো সরকার গঠন করেই বাস্তবায়ন সম্ভব।

ফলে এগুলোকে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয় হিসেবেও গণ্য করা যায়। তা ছাড়া, মাহমুদুর রহমান মান্না ইতিমধ্যে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে কে কতটা সময় ক্ষমতায় থাকবে, তা-ও আলোচনায় এনেছেন। নির্বাচনে অনিবন্ধিত জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ও সমর্থকেরা অঘোষিতভাবে বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় পারস্পরিক স্বার্থে যে সক্রিয় থাকবেন, সে কথা না বললেও চলে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক সূচকসমূহে দেশের উন্নতি হলেও রাজনৈতিক চেতনা ও ভূমিকার যে ব্যাপক পশ্চাদপসরণ ও অবক্ষয় হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী দলগুলোর মধ্যে যারা ক্ষমতায় থেকে সার্বিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে আছে। আর যারা রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তারা দুই বড় দলের বাইরে থেকে তৃতীয় একটি জোট গঠন করে মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে।

তবে নাগরিক সমাজের মধ্যে বরাবর যাঁরা রাজনৈতিক, সামাজিক নানা ইস্যুতে সক্রিয় থাকেন, তাঁদের সিংহভাগ মনে করেন, নির্বাচন মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেই হবে। দুই দলই যদিও বাম, মধ্য ও দক্ষিণপন্থী নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের সঙ্গে জোট গঠন করেই নির্বাচন বা সরকার গঠন করছে, তবু মূল দলের সঙ্গে অন্যদের সাংগঠনিক ও সমর্থক-শক্তির তারতম্য এত বেশি যে কার্যত সরকারে এক দলের প্রভাবই কার্যকর থাকে। তবে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ স্পষ্ট ও জোরালো হওয়ায় তারাই এই জোটের নীতি ও ভূমিকা নির্ধারণে প্রভাবক ভূমিকা পালন করতে পারে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিষয়ে নাগরিক সমাজের বড় অংশের শঙ্কা ও আপত্তির মূল কারণ এখানেই।

গত এক–দেড় যুগের জঙ্গি হামলা ও তৎপরতা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এরা নানা উগ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও মূলে বা উৎসে আছে জামায়াতই, এবং বিএনপির একটি অংশ তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ কথাও সবার জানা, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ইসলামি জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এ বিষয়টি ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও অস্পষ্ট নয়।

আপাতত তাদের বিবেচনায় ইসলামি জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে বড় বাধা। ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যেনতেন নির্বাচন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বিবাদে ক্ষমতা ভোগ করে যেতে পেরেছে। তার থেকে পরিস্থিতির তেমন গুণগত পরিবর্তন এযাবৎ হয়নি। আওয়ামী লীগ এই সমর্থনকে প্রশ্রয় হিসেবে কাজে লাগাতে পারছে।

বিএনপি যদি সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে স্বাধীন অবস্থান নিত, তাহলে সম্ভবত দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল্যায়নের কিছু পরিবর্তন ঘটত। তেমন সম্ভাবনা এখনো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর বিএনপি নতুনভাবে নেতৃত্বসংকট ও রাজনৈতিক সংকটেই পড়েছে। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার মূল কুশীলবদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ২০০৪ সালে ক্ষমতাসীন অবস্থায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যাচেষ্টার জন্য বিএনপির দিকে বরাবর আঙুল উঠেছে।

গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণে তখনকার সরকারের ভূমিকা সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। ক্ষমতায় থেকে দুটি ঘটনার তদন্ত ও বিচারে বিএনপির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত। তা সত্ত্বেও বিএনপি যে বিপুল সমর্থন ও ভোট পেয়ে থাকে, তার কারণ আমাদের সমাজে বিচার ও মূল্যায়ন এখনো আইন ও ন্যায়বোধের ভিত্তিতে হয় না। প্রতিপক্ষের প্রতিপক্ষ আমার মিত্র—এই আদিম নীতিবোধেই চলে আসছে।

আওয়ামী লীগের একটি সাচ্চা বিরোধী দলের চাহিদা সমাজে রয়েছে, গণতন্ত্রের বিকাশেও তা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালনে বিএনপিই সক্ষম। ফলে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ও জাতীয় ইতিহাস বিকৃতির মতো অভিযোগে বিদ্ধ হলেও দলটির কার্যকারিতা থেকে যাচ্ছে। বাম দলগুলো এককাট্টা হয়েও চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়নি।

এত সব দৃষ্টিগ্রাহ্য উন্নয়ন, সরকারি সকল পর্যায়ে বেতন–ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সূচকে দেশের চমকপ্রদ অগ্রগতি, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও স্বীকৃত হচ্ছে, তার কৃতিত্ব তো এ সরকার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই পাবে—এ কথা ঠিক। এ কারণে চলতি মেয়াদে আওয়ামী লীগ সমাজে তার ঐতিহ্যগত অনেক প্রতিপক্ষকে জয় করতে পেরেছে এবং আগের তুলনায় শক্তিশালী অবস্থানে আছে। কিন্তু তা জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের নিশ্চয়তা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তার কারণ দুর্নীতি, বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য। এতে দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি হচ্ছে, নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক স্বস্তি সত্ত্বেও নাগরিক জীবন স্বস্তিময় হচ্ছে না। তাতে নানান হিসাব–নিকাশ বিবেচনায় না নিয়ে, কিংবা তা নিয়েও মানুষ পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকতে পারে।

বাংলাদেশে হয়তো ভারতবিরোধিতা ও আওয়ামী লীগের হাতে ইসলাম বিপন্ন—এ ধরনের স্লোগান আর কার্যকর হবে না। বরং দুর্নীতি ও সুশাসনের মতো বিষয় ভোটারদের বিবেচনায় থাকবে। এটাকে রাজনৈতিক চেতনার উন্নতি হিসেবে গণ্য করা যায়। এ ছাড়া তরুণসমাজের মধ্যে দেশ ও জনস্বার্থের চেতনা গত শতকের আশি-নব্বই ও এ শতকের প্রথম দশকের তুলনায় অনেক প্রসারিত ও ভবিষ্যৎমুখী হয়েছে। অর্থাৎ নতুন প্রযুক্তি, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির অভাবিত বিস্তার ও সুলভ প্রাপ্যতার কারণে জ্ঞান, চিন্তা এবং কাজের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নেই।

ফলে এ সময়ে রাজনীতিতেও সার্বিক গুণগত পরিবর্তন আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেটি যেমন চিন্তাভাবনা ও কর্মসূচির ক্ষেত্রে ঘটবে, তেমনি তার আলোকে সাংগঠনিক কাঠামো বদল এবং কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নেতৃত্বের সম্পর্ক ও তাঁদের ভূমিকাতে পরিবর্তন ঘটানো জরুরি। কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান ও উপরিকাঠামোয় কিছু ব্যবহারিক পরিবর্তনে তা সাধিত হবে না। যদি হতো তাহলে সরকারের সাফল্য সত্ত্বেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ কেন দিনে দিনে স্থবিরতা ও অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক নতুন সন্ধিক্ষণে যেমন এসেছে, তেমনি এক রাজনৈতিক নবযাত্রার ক্রান্তিলগ্নেও পৌঁছেছে। সে কাজটা তামাদি হয়ে পড়া রাজনীতিকদের দিয়ে হবে না, তামাদি চিন্তার নবীন রাজনীতিকদের দিয়েও হবে না। আওয়ামী লীগ অতীতে বারবার রাজনৈতিক চিন্তায় সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। এখন আরেকবার রাজনীতিতে সৃজনশীলতার জোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এটাই শেখ হাসিনার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, চ্যালেঞ্জ বাম দলগুলোর সামনে, সব দলের নবপ্রজন্মের তরুণ নেতা-কর্মীদের সামনেও। সাধারণভাবে দেশের অগ্রসর চিন্তার মানুষ ও তরুণ প্রজন্মের সামনে চ্যালেঞ্জ এই একটাই।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক