খাসোগি বুমেরাং হবে সৌদি আরবের?

জামাল খাসোগি
জামাল খাসোগি

প্রতিপক্ষ বা অপছন্দের ব্যক্তিকে নানাভাবেই সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে রাষ্ট্রশক্তি। এর মধ্যে গুম হচ্ছে একটি। রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি কে; এটা নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল। কিন্তু এর সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। প্রকৃতপক্ষে এ রকম তথ্য পাওয়া সম্ভবও নয়। তবে ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলে থাকেন, রোমান ও গ্রিক সভ্যতার আমলে এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে। ওই সময় যাঁরা অভিজাত শাসক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করতেন, তাঁদের কারও কারও জীবন নাশ হয়েছিল, যেমন সক্রেটিস। হয়তোবা কেউ গুম বা গুপ্তহত্যার শিকারও হতে পারেন। ইতিহাসে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু গুমের বিষয়টি নজরে আসতে থাকে গত শতকের আশির দশকের শুরুতে। ওই সময় চিলিতে কিছু জেলবন্দী হঠাৎ করেই হারিয়ে যান। এরপর তো দক্ষিণ আমেরিকায় গুমের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে।

হাল আমলেও নাগরিকদের গুম করে দেওয়ার অসংখ্য নজির আছে। এর সর্বশেষ আলোচিত ঘটনা হচ্ছে সৌদি শাসকের সমালোচক জামাল খাসোগি নিহত হওয়া। এ ধরনের গুম বা খুনের ঘটনা আরবের রাজনীতিতে বিরল নয়। এক ইসরায়েলের হাতেই অসংখ্য ফিলিস্তিনি গুম হয়েছেন বা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। আর লিবিয়া থেকে ইরান পর্যন্ত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমানোর জন্য গুম–খুনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তবে এসব গুম, খুন, গুপ্তহত্যাকারী কোনো শাসকই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা সাদ্দাম হোসেন নিকট অতীতের নিষ্ঠুর উদাহরণ। আর হিটলারের পরিণতিও আমরা দেখেছি। ইতালির মুসোলিনি বা রোমানিয়ার চসেস্কুর পরিণতিও খুব একটা ভালো হয়নি। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, যুগে যুগেই গুম, খুন, গুপ্তহত্যায় দায়ী শাসকদের কমবেশি সবারই করুণ, অস্বাভাবিক পরিণতি হয়েছে।

নিখোঁজের ১৭ দিন পর সৌদি রাজপরিবারের কট্টর সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগির মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে সৌদি আরব। সৌদি কর্তৃপক্ষ বলেছে, খাসোগি আর বেঁচে নেই। এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে রিয়াদের ব্যাখ্যা, খাসোগিকে হত্যা করা হয়নি। তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে ‘মারামারিতে’ তিনি নিহত হন। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে প্রথমবারের মতো সৌদি আরব খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে। বলাই বাহুল্য খাসোগির এ ঘটনার পর সৌদি আরবের অভ্যন্তরে এর খুব একটা প্রতিক্রিয়া হবে না। ভোগবাদী সৌদিদের কোনো কিছুতেই খুব একটা হেলদোল নেই। নতুবা বছরের পর বছর অপশাসন সৌদিতে টিকে থাকতে পারত না।

প্রভাব পড়বে আরবের আঞ্চলিক রাজনীতিতে। আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার পথে খাসোগির ঘটনা যেমন শক্তি জোগাবে, আবার বিপাকেও ফেলবে সৌদিকে। শক্তি জোগাবে এই অর্থে যে, শেষ পর্যন্ত যদি সৌদি আরব বা সুনির্দিষ্ট করে বললে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিষয়টি সামলে ফেলতে পারেন, তবে তা হবে সৌদির ক্রমবর্ধমান শক্তির বহিঃপ্রকাশ। কূটনৈতিক এসপিওনাজের দক্ষতা। অন্য দেশে ঢুকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিরাপদে ফিরে আসতে দক্ষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের দরকার হয়। তুরস্কের ভেতরে ঢুকে কাউকে হত্যা করে আসা বা গুম করে আসা মোটেও সহজ বিষয় নয়। অবশ্য কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, সৌদি আরবকে এই অপারেশন পরিচালনায় ইসরায়েল সহায়তা করে থাকতে পারে। যা–ই হোক, খাসোগির ঘটনা হজম করে ফেলতে পারলে সৌদি হেজেমনিকে আরবের রাজনীতিতে স্থান দিতে হবে।

আর বিপাকে পড়বে এই অর্থে যে, ইতিমধ্যে সৌদি আরবের আধিপত্য বিস্তারের কুৎসিত কদাকার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়েছে; বরং এতে করে সৌদির গণতন্ত্রহীনতাকে উল্লেখ করে ভিন্ন অক্ষের দেশগুলো নিজেদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের সুযোগ নেবে। সৌদির আগ্রাসী আচরণ ইরান, তুরস্ক বা সিরিয়ার আচরণকে একধরনের বৈধতা দেবে, বিশেষ করে সৌদির আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান এ ঘটনা থেকে সুবিধা আদায় করতে চাইবে। অথচ ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের বিরুদ্ধেই ইরানের ভেতরে ও বাইরে অনেক গুম, গুপ্তহত্যার অভিযোগ আছে।

তুরস্কের পক্ষেও এ ঘটনা হজম করা সহজ না। কারণ এটি তুরস্কের ইগোর সঙ্গে জড়িত। যদি এই ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েল জড়িতই থাকে, তবে তা হবে তুরস্কের জন্য এক বড় ধরনের পরাজয়। তুরস্ক এর প্রতিধোশ নিতে পারে দুইভাবে। প্রথম সৌদিবিরোধী শক্তি ইরান, সিরিয়াসহ অন্যদের নিয়ে সৌদি ইমেজ ঘায়েল করার জন্য মাঠে নামবে। সৌদিকে যতটা সম্ভব অগণতান্ত্রিক, মানবাধিকারহীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রচারণা চালাবে। দ্বিতীয়ত, সৌদির বিভিন্ন স্বার্থে আঘাত হানবে তুরস্ক।

মোদ্দাকথা, এত দিন ইরান, হালে তুরস্ককের শাসকগোষ্ঠীকে এই অঞ্চলের খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ সৌদি নেতৃত্বের চলছিল, তা এখন বিপরীতমুখী হবে। সৌদি নিজেই এখন খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নানাভাবে নিজেদের উদার হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন; অবশ্য সৌদি জনসাধারণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া। যেকোনো কর্তৃত্ববাদী শাসকের চরিত্র হচ্ছে লোক দেখানো কর্মসূচি দিয়ে নিজের কুৎসিত দিকটি আড়াল করার চেষ্টা করা। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, ধর্মীয় উদারতা, নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, তরুণদের প্রাধান্য, চলচ্চিত্র প্রদর্শন—এসব করে যুবরাজ সালমান নিজেকে উদার হিসেবে পশ্চিমাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এক খাসোগির ঘটনাই এসবে জল ঢেলে দিচ্ছে।

খাসোগির ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করবে। ইতিমধ্যেই চাপের মুখে মার্কিন প্রেমিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুবরাজ সালমানের সঙ্গে কথা বলে সবাইকে আশস্ত করার চেষ্টা করেছেন এই বলে, যুবরাজ সালমান খাসোগির সম্পর্কে কিছু জানেন না। বস্তুত যুবরাজের সব কুকর্মকে মার্কিনরা অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে সৌদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করছে। সৌদিকে তুষ্ট রাখতে গিয়েই ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এসেছে। এর বিনিময়ে সৌদি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আরবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। ইয়েমেনে হামলা, কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ—এসবই তার বহিঃপ্রকাশ।

খাসোগির ঘটনাই প্রথম না। শক্তি প্রকাশের জন্য এর আগেও সফরে আসা লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরিকে আটকে রেখেছিল সৌদি। হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন সৌদির শাসকেরা। হারিরির অপরাধ ছিল ইরান–ঘনিষ্ঠতা। ইরানের ঘনিষ্ঠ কাতারকেও অবরোধ করে শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সৌদির সেসব কৌশল সফল হয়নি; বরং বুমেরাং হয়েছে। খাসোগির ঘটনাও আবার বুমেরাং না হয়ে ফিরে আসে সৌদি আরবের জন্য।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন